পাবলিক রিলেশন (পিআর) এজেন্সির যুগ। সবকিছুই ‘ইমেজ’ তৈরির নির্ভর করে। আর সেই যুগে দাঁড়িয়ে একজন বিরল মানুষ হয়ে থেকে গেলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। ‘ইমেজ’ বজায় রাখার থেকে তিনি যে নিজের মনের কথাটা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পেরে খুশি হন, সেটা অশ্বিনের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে। মাপজোক করে নয়, কাউকে খুশি করার জন্য নয়, নিজের মনের কথা বিন্দাস ভাবে বলেন। ক্রিকেটের ভালো, মন্দ, বিতর্ক, খামতি সবকিছু নিয়ে কথা নিজের মতপ্রকাশ করেন। কোন রঞ্জি ট্রফির ম্যাচে কে ভালো খেললেন, বিশ্বের অন্য প্রান্তের কোনও ম্যাচে অন্য কে ভালো পারফরম্য়ান্স করলেন, সেই বিষয়ে নিয়মিত মুখ খোলেন। এমনকী ভারতীয় খেলোয়াড়দের নিয়ে কেউ ঠাট্টা করলে, আক্রমণ করলে মাঠের বাইরে রুখে দাঁড়ান। ২০২২ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দীপ্তি শর্মা যখন আইনসিদ্ধ ‘নন-স্ট্রাইকার্স এন্ডে রান-আউট’ করেছিলেন, তখন তাঁর সমালোচনা করেছিলেন জেমস অ্যান্ডারসন, স্যাম বিলিংসের মতো খেলোয়াড়রা। স্পিরিট কপচানো ইংরেজদের পালটা দিয়েছিলেন অশ্বিন। যেটা হয়তো তাঁর দরকার ছিল না। কিন্তু তাও করেছিলেন অশ্বিন।কারণ তিনি তো আর পাঁচজন নন, তিনি রবিচন্দ্রন অশ্বিন - দ্য ম্যান, দ্য মিথ।
‘সায়েন্টিস্ট’ অশ্বিন!
আর নিজের সেই স্বভাবটা কখনও পালটাননি অশ্বিন। প্রায় দেড় দশকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কেরিয়ারে নিজের বোলিং, ব্যাটিংয়ের ধরন পালটেছেন। নিজেকে নতুনভাবে মেলে ধরেছেন। বারেবারে চমক দিয়ে গিয়েছেন। টি-টোয়েন্টির জন্য নিজের খেলাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন। অন্যরা পিছিয়ে গিয়েছেন, ‘সায়েন্টিস্ট’ অশ্বিন নতুন-নতুন ‘অস্ত্র’ আবিষ্কার করে খেলে গিয়েছেন।
T20-তে নিজের ব্যাটিং পালটে ফেলেছিলেন অশ্বিন!
গত দশকের শেষের দিকে সবথেকে বড় পরিবর্তনটা করেছিলেন অশ্বিন। সেইসময় একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম ফর্ম্যাট থেকে অফস্পিনারদের গুরুত্ব ক্রমশ কমছে। ক্রমশ পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছেন ফিঙ্গার স্পিনাররা। বরং ‘ম্যাচ-আপ’-র যুগ চলছে। আর সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে টি-টোয়েন্টি দলে রাখতে ব্যাটিংয়ের আমূল পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। কেরিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ সময় এসে আড়াআড়ি ব্যাটে খেলতে শুরু করেছিলেন। একাধিকবার নিজের স্টান্স পালটেছিলেন।
আরও পড়ুন: ভিডিয়ো: ব্যাটে রান নেই, তাহলে কি এবার বিদায়ের পালা? খোলাখুলি উত্তর দিলেন রোহিত
আর সেই পরিবর্তনের সুবাদেই যে খেলোয়াড়ের ২০০৯ সালে আইপিএলে অভিষেক হয়েছিল, তিনি ২০২২ সালে এসে প্রথমবার ১০০ বল খেলেছিলেন। ততদিনে আইপিএলে মোট যতগুলি ছক্কা মেরেছিলেন, সেটার প্রায় অর্ধেকই মেরেছিলেন ২০২২ সালে। সেই বছর তিনটি ইনিংসে তিন নম্বরে ব্যাটও করেছিলেন। অশ্বিন খুব ভালোভাবে জানতেন যে তিনি স্রেফ ‘পাওয়ার’ দিয়ে পিঞ্চহিটার হতে পারবেন না। তাই ‘সায়েন্টিস্ট’-র তকমা বজায় রেখে নিজের ব্যাটিং নিয়ে অনেক পরিবর্তন করেছিলেন।
আর শুধু ব্যাটিংয়ে নয়, ২০২২ সালের আইপিএলের নিজের বোলিংয়েরও অনেক পরিবর্তন করেছিলেন অশ্বিন। টি-টোয়েন্টির বস্তাপচা ‘ম্যাচ-আপ’-র ধারণা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বাঁ-হাতি ব্যাটারের থেকে বেশি ডানহাতি ব্যাটসম্যানকে আউট করেছিলেন। আর ‘ম্যাচ টার্নিং’ উইকেট নিচ্ছিলেন। খাতায়কলমে প্রচুর উইকেটের সংখ্যা বেশি না থাকলেও ম্যাচ জেতাচ্ছিলেন অশ্বিন। নিজেকে পালটে ফেলেছিলেন ভারতীয় তারকা- সদ্যপ্রাক্তন ভারতীয় তারকা।
তামিল ‘কুট্টি স্টোরিস’ করতেন অশ্বিন, ছিল আবেগ
নিজের সেই পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত রেখে বছরকয়েক আগে ইউটিউব চ্যানেল খুলে ফেলেন অশ্বিন। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে নিয়মিত ভিডিয়ো করতেন। তবে সবথেকে বেশি হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল ২০২০-২১ সালের বর্ডার-গাভাসকর ট্রফির সময় অশ্বিনের ‘কুট্টি স্টোরিস’। সেই কঠিন সময় কীভাবে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, গাব্বায় ঐতিহাসিক জয় কীভাবে এসেছিল, তা নিয়ে নিজের কাহিনী ভাগ করে নিতেন। আর সেটা নিজের মাতৃভাষা তামিলে করতেন। অনুবাদ থাকত। কিন্তু কথাগুলোর বোঝার সময় সবসময় অনুবাদের প্রয়োজন হত না। কারণ সেই কাহিনীতে থাকত আবেগ।
আর চার বছর পরে সেই অস্ট্রেলিয়া থেকেই অবসর ঘোষণা করলেন অশ্বিন। এবারও কি কোনও ‘কুট্টি স্টোরিস’ করবেন? উত্তরটা একমাত্র দিতে পারবেন অশ্বিনই।