মা মুখোপাধ্যায় বাড়ির মেয়ে। তিনি নিজে কলকাতার অন্যতম দুর্গাপুজো কমিটির মাথায় আছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরে যিনি অন্যতম ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নেতা হিসেবে পরিচিত, সেই ফিরহাদ হাকিমের (ববি নামে পরিচিত) একাধিক ‘সাম্প্রদায়িক’ মন্তব্য নিয়ে সম্প্রতি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এমনকী বিষয়টি নিয়ে দলেরই নেতা-কর্মী-সমর্থকরা উষ্মাপ্রকাশ করতে শুরু করেছেন। কেউ প্রকাশ্যে ক্ষোভের কথা বলছেন। কেউ বলছেন আড়ালে-আবডালে। তাঁদের মতে, দলের তরফে ফিরহাদের বিরুদ্ধে ‘স্টেপ’ নেওয়া উচিত। কারণ ‘মন্তব্য করার পরে প্রত্যেকবার মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে বলাটা খুব খারাপ ডিফেন্স।’
‘আল্লাহের রহমত থাকলে আমরা মেজরিটির থেকে মেজরিটি হব’
যদিও এবারের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে এখনও পর্যন্ত ‘ডিফেন্স’ করতে নামেননি ফিরহাদ। শনিবার আলিপুরে একটি অনুষ্ঠানে সেই মন্তব্য করার পরে বিজেপি তুমুল আক্রমণ শানালেও ফিরহাদ নতুন করে কোনও মন্তব্য করেননি। ওই অনুষ্ঠানে রাজ্যের মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এমন একটা সম্প্রদায়ের লোক, যে সম্প্রদায়....বাংলায় তো আমরা ৩৩ শতাংশ। কিন্তু ভারতে মাত্র ১৭ শতাংশ। আর আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলা হয়। কিন্তু আমরা নিজেদের সংঘ্যালঘু হিসেবে বিবেচনা করি না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা ভাবি যে আমাদের উপরে যদি আল্লাহের রহমত থাকে, তালিম যদি আমাদের পক্ষে থাকে, তাহলে একদিন আমরা মেজরিটির থেকেও মেজরিটি হয়ে যেতে পারি। আমরা যদি নিজেদের শক্তি দিয়ে এটা অর্জন করতে পারি, তাহলে সেটা আল্লাহের কৃপা হবে।’
সেখানেই থামেননি ফিরহাদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের সম্প্রদায়....অনেক জায়গায় আমি দেখি যে কিছু হলেই মোমবাতি মিছিল করে থাকে। উই ওয়ান্ট জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস। আমি বলি, মিছিল করে জাস্টিস হবে না। নিজের ক্ষমতা এমন করতে হবে যে আপনি নিজেই জাস্টিস দেওয়ার যোগ্য হবেন, জাস্টিস চাইবেন না। জাস্টিস দেবেন।’
কোন প্রেক্ষিতে তিনি সেই ‘সংখ্যালঘু’ হওয়ার কথা এবং ‘জাস্টিস’ দেওয়ার কথা বলেছেন, সেটা ওই ভাষণেই ব্যাখ্যা করে দেন ফিরহাদ। তাঁর কথায়, ‘আজও কলকাতা হাইকোর্ট থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট- হাতেগোনা কয়েকজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিচারপতি আছেন। কারণটা কী? কারণ এতদিন আমাদের সেটার যোগ্য করে তোলা হয়নি। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে বিচার দিতে পারি।’
সেইসঙ্গে ফিরহাদ জানান, সবসময় সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়। সমাজতন্ত্রের মানে এই নয় যে যিনি বড় জায়গায় আছেন, তাঁকে টেনে নামানো হবে। বরং সেই বড় জায়গায় পৌঁছাতে হবে নিজেকে। তাই তিনি বলেছেন যে আজ মুসলিমরা সংখ্যালঘু আছেন, কাল থাকবেন না। সকলে আগে এগিয়ে যাবেন।
ফিরহাদকে আক্রমণ বিজেপির
আর সেই বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল ও ফিরহাদকে আক্রমণ শানাতে ছাড়েননি তথ্যপ্রযুক্তি সেলের প্রধান অমিত মালব্য। তিনি বলেন, ‘উনি এখন বলেছেন যে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও শীঘ্রই মুসলিমরা সংখ্যাগুরু হয়ে উঠবেন। হাকিম এমন একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন, যেখানে মুসলিমদের কোনও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বা মিছিলের উপরে নির্ভর করতে হবে না। বরং নিজেদের হাতেই বিচার তুলে নিতে পারবেন। সম্ভবত শরিয়ত আইনের ইঙ্গিত করেছেন (ফিরহাদ)।’
ফিরহাদের পুরনো ‘ধর্মীয়’ মন্তব্যও তুলে ধরেছেন বিজেপি নেতারা। গত জুলাইয়েই ফিরহাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করার অভিযোগ তুলেছিলেন তাঁরা। সেইসময় একটি ভিডিয়ো (সত্যতা যাচাই করেনি হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা) পোস্ট করেছিলেন বঙ্গ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তাতে যে ব্যক্তির শোনা যাচ্ছিল, তিনি আদতে ফিরহাদ ছিলেন বলে দাবি করেছিলেন।
আগেও বিতর্কে জড়িয়েছেন ফিরহাদ
আর ভিডিয়োয় (সত্যতা যাচাই করেনি হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা) শোনা গিয়েছিল, ‘যাঁরা দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে, যাঁরা ইসলাম নিয়ে জন্মাননি, তাঁদেরও দাওয়াত-এ-ইসলাম...অর্থাৎ ইসলামে দাওয়াত দিয়ে তাঁদের মধ্যে ইমান নিয়ে আসলে আল্লাহ-তালাকে খুশি করা হবে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন, তাঁদের মধ্যে ছড়াতে হবে।’ সেইসঙ্গে ওই ভিডিয়োয় শোনা গিয়েছিল, ‘....শক্তিশালী মনে হয়, যখন দেখি সবাই এখানে টুপি পরে আছেন, হাজার-হাজার মানুষ বসে আছেন, তখন মনে হয় ইসলামের ঐক্য একটা জায়গায় আছে, যেখানে কেউ কোনওদিন আমাদের দমাতে পারবে না।’
সেইসময় বিজেপির অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছিলেন ফিরহাদ। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার মনে হয় যে আমি সাম্প্রদায়িক হতে পারি? ইয়েস অর নো - চেঁচিয়ে (বলুন)? নো। সুতরাং বিজেপি কী করছে, (সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই)। ও **** গেলে, ওর *** আমি পা দেব না। আমি আমার নিজের ধর্ম মানি। আমি দুর্গাপুজো করি। কালীপুজো করি। যাঁরা মূর্খ, তাঁরা আমায় সাম্প্রদায়িক বলেন। নো কোয়েশ্চনস।’
ফিরহাদ ‘নো কোয়েশ্চনস’ বললেও তাঁকে এখনও ‘মিনি পাকিস্তান’ বলা মন্ত্রী হিসেবে খোঁচা দেয় বিজেপি। ফিরহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে তিনি নাকি মেটিয়াবুরুজকে ‘মিনি পাকিস্তান’ বলেছেন। যদিও সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আসেন ফিরহাদ। তিনি দাবি করেন যে এক পাকিস্তানি সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। যিনি তাঁর মুখে উলটো-পালটা কথা বসিয়ে দিয়েছিলেন। আর তা নিয়ে বিজেপি অহেতুক বিতর্ক তৈরি করেছে বলে দাবি করে এসেছেন ফিরহাদ।
হিন্দু ও মুসলিম পরিবার আর ফিরহাদ
তিনি বরং দাবি করেছেন যে এই ধর্ম নিয়ে বিতর্ক বা বিভেদের মূলে আছে বিজেপি। ছোটবেলায় কখনও এসব দেখেননি। অথচ তাঁর বাবা এবং মায়ের পরিবারের ধর্মীয় বিশ্বাস আলাদা ছিল। তাঁর দাদুর নাম ছিল সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। সেই মুখোপাধ্যায় পরিবারের মেয়ে ছিলেন তাঁর মা। বিয়ে হয়েছিল হাকিম পরিবারে। উর্দুও শিখেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে প্রকাশিত বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফিরহাদের ছেলেবেলার বন্ধু ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন যে কোনওদিনই ববির মধ্যে কোনও হিন্দু-মুসলিম ব্যাপার ছিল না।
তৃণমূল কোনও পদক্ষেপ করবে?
তারপরও যেভাবে সম্প্রতি একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে ফিরহাদের বিরুদ্ধে, সেই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের তরফে ফিরহাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় কিনা, তা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বিশেষত মেরেকেটে ১৫ মাস পরে হতে চলা বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বিজেপির হাতে কোনও ‘অস্ত্র’ তুলে না দিতে তৃণমূল কোনও ‘স্টেপ’ নেবে কিনা, সেদিকে রাজনৈতিক মহলের নজর আছে।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, ফিরহাদের বিরুদ্ধে যদি তৃণমূল সত্যিই কোনও ‘পদক্ষেপ’ করে, তাহলে সেটা বড় বার্তা হবে। কারণ তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে আছেন ফিরহাদ। দীর্ঘদিন ধরে মমতার অনুগামী হলেও দলের অন্দরে তাঁর রাজনৈতিক ওজন আরও বেড়েছিল মুকুল রায়ের তৃণমূল ত্যাগের পরে।
শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, ২০১৯ সাল থেকে তৃণমূলের সংখ্যালঘু মুখ হিসেবেও বেশ গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় ফিরহাদের। লোকসভা নির্বাচনে জোরদার ধাক্কার পরে ভারসাম্য রক্ষার পথে হেঁটেছিলেন মমতা। লোকসভা ভোটে সংখ্যালঘু-পন্থী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। আর ভোটের পরে যখন ‘ভারসাম্য’ রক্ষা করতে হয়েছিল, তখন ফিরহাদের থেকে তৃণমূলের হাতে ভালো বিকল্প কেউ ছিলেন না।
আর ফিরহাদ কি এখন সেই ভারসাম্যটা রক্ষা করতে পারবেন? সেই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ফিরহাদের ভাগ্যের পেন্ডুলাম কোনদিকে যাবে, সেটা নির্ভর করছে।