মহিলাদের সাহায্য করার জন্য যে কঠোর আইন আনা হয়েছে, তা কখনই স্বামীদের হেনস্থা করা, ভয় দেখানো বা তাঁদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার জন্য অপব্যবহার করা যাবে না। বৃহস্পতিবার একটি মামলা প্রসঙ্গে এমনই পর্যবেক্ষণ করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
শীর্ষ আদালত আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে, বিবাহ বিচ্ছেদের পর প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে প্রাক্তন স্ত্রী খোরপোষ বাবদ যে অর্থ পান, তা তাঁকে এই কারণে দেওয়া হয় না, যাতে তিনি বিবাহ বিচ্ছেদের আগে যেভাবে জীবন যাপন করতেন, তা বজায় রাখতে পারেন।
বরং, বিবাহ বিচ্ছিন্না মহিলাদের খোরপোশ এই কারণে দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা তাঁদের জীবন যাপনের সম্মানজনক একটা মান বজায় রেখে এগিয়ে যেতে পারেন।
উল্লেখ্য, কিছু দিন আগেই তরুণ প্রযুক্তিবিদ, বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা অতুল সুভাষের আত্মহত্যার ঘটনা সারা দেশের মানুষকে নড়িয়ে দিয়েছে! অতুল তাঁর দীর্ঘ সুইসাইড নোট, শেষ চিঠি এবং একটি দীর্ঘ ভিডিয়ো বার্তায় জানিয়ে গিয়েছেন, কীভাবে তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী ও প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা খোরপোষ আদায়ের নামে তাঁর উপর লাগাতার অত্যাচার করে গিয়েছেন।
সবথেকে বড় কথা হল, এই অত্যাচারের জন্য বিচার বিভাগের একাংশের ভূমিকারও তীব্র সমালোচনা করেছেন অতুল সুভাষ। এমনকী, অতুলের আত্মহত্যার ঘটনার পরই আরও কয়েকটি একই ধরনের মর্মান্তিক ও নির্মম আত্মহত্যার ঘটনা সামনে এসেছে।
সেই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার শীর্ষ আদালত এই যে পর্যবেক্ষণটি করেছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করেছে, একজন ব্যক্তি তাঁর বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে তাঁর প্রাক্তন স্ত্রীর চাহিদা মেটানোর দায়ভার অনন্তকালের জন্য নিতে বাধ্য হতে পারেন না।
একইসঙ্গে আদালত তার পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে, হিন্দু বিবাহকে সর্বদাই একটি পবিত্র বন্ধন তথা প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করা হয়। কারণ, তা একটি পরিবারের ভিত্তি রচিত করে। এই বিবাহকে কখনই 'বাণিজ্যিক প্রকল্প' হিসাবে গণ্য করা বা ব্যবহার করা যায় না।
সংশ্লিষ্ট মামলা প্রসঙ্গে বিচারপতি বি ভি নাগারত্না এবং বিচারপতি পঙ্কজ মেহতার বেঞ্চ স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়, 'মহিলাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং বুঝতে হবে, তাঁদের হাতে যে আইনি অস্ত্র রয়েছে, তা শুধুমাত্র তাঁদের কল্যাণের উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু, কখনই এই আইনকে হাতিয়ার করে তাঁরা তাঁদের স্বামীদের শাস্তি বা হুমকি দিতে, আধিপত্য কায়েম করতে, অথবা টাকা আদায় করতে পারেন না।'
যে মামলার শুনানি চলাকালীন এই পর্যবেক্ষণ করেছে সুপ্রিম কোর্ট, সেই মামলাটিরও নিষ্পত্তি বৃহস্পতিবারই করে দেওয়া হয়। আদালত সংশ্লিষ্ট দম্পত্তিকে আইনত বিচ্ছিন্ন ঘোষণা করে রায় দেয়। সংশ্লিষ্ট পুরুষটিকে বলা হয়, তাঁকে আগামী একমাসের মধ্যে তাঁর প্রাক্তন স্ত্রীকে ১২ কোটি টাকা খোরপোষ দিতে হবে। এবং সেটাই হবে 'ফুল অ্য়ান্ড ফাইনাল সেটলমেন্ট'। অর্থাৎ, এরপর আর ওই মহিলা তাঁর প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে একটি পয়সাও দাবি করতে পারবেন না।
কিন্তু, মহিলা তাতে খুশি ছিলেন না। তাঁর বক্তব্য ছিল, তাঁর প্রাক্তন স্বামীর মোট ৫,০০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। ভারত ও আমেরিকায় তাঁর একাধিক সম্পত্তি রয়েছে। এবং তিনি যখন তাঁর প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন, তখন খোরপোষবাবদ তাঁকে ৫০০ কোটি টাকা এবং ভার্জিনিয়ায় একটি বাড়ি দিয়েছিলেন।
এর প্রেক্ষিতে আদালত বলে, স্বামীর কত টাকা বা কত রোজগার আছে, আদালত শুধুমাত্র সেটুকুই বিবেচনা করবে না। আদালতকে এও বিবেচনা করে দেখতে হবে যে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মহিলার রোজগার কত, তাঁর সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার জন্য কীরকম অর্থের প্রয়োজন, তাঁর বাসস্থানের অধিকার কী এবং আরও অনেক কিছু।
আদালত আরও বলে, 'আমরা প্রায়ই দেখতে পাচ্ছি, এক পক্ষ (প্রাক্তন স্ত্রী) সেই সম-পরিমাণ সম্পদ দাবি করছে, যা অপর পক্ষের (প্রাক্তন স্বামী) কাছে রয়েছে। আমরা এই দাবি মানতে পারি না। দেখা যাচ্ছে, এক পক্ষ সেই পরিমাণ অর্থ দাবি করছে, যা তাদের প্রাক্তন স্বামীর অর্ধেক। অর্থাৎ, সমান-সমান সম্পদের ভাগাভাগি চাওয়া হচ্ছে।'
আদালত আরও প্রশ্ন তোলে, 'যদি বিবাহ বিচ্ছেদের পর কোনও অঘটনের জেরে স্বামী দরিদ্র হয়ে যান, তখনও কি প্রাক্তন স্ত্রী তার (সেই দারিদ্র্যের) সমান ভাগীদার হতে চাইবেন?'
এরপরই আদালত সেইসব উদাহরণ টেনে আনে, যেখানে আইনি রক্ষাকবচের অপব্যবহার করে প্রাক্তন স্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা প্রাক্তন স্বামীর উপর কার্যত জুলুমবাজি করেছেন! এক্ষেত্রেও তেমনটা করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট মহিলা তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি ধারাতেও মামলা রুজু করেছিলেন। শীর্ষ আদালত সেই মামলা খারিজ করে দিয়েছে।