কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে একের পর এক নিরস্ত্র পর্যটককে গুলি করে খুন করা হয়েছে। 'টার্গেট' স্থির করার আগে জঙ্গিরা তাঁদের নাম ও ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে! এমন নরকীয় ঘটনায় ফুঁসছে গোটা দেশ। উঠছে প্রতিশোধ নেওয়ার দাবি।
নানা সূত্রের খবর, এই হামলার নেপথ্যে রয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু, ইসলামাবাদ সেকথা স্বীকার করেনি। যদিও পহেলগাঁওয়ে হত্যালীলার পর ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপ করেছে ভারত সরকার। সেইসঙ্গে, জঙ্গিদের ও তাদের মদতদাতাদের পাকড়াও করতে ধরপাকড়ও শুরু হয়েছে। অন্যদিকে, সোশাল মিডিয়ায় যুদ্ধের জিগির উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু, যুদ্ধই কি পাকিস্তানকে জবাব দেওয়ার একমাত্র পথ?
এই বিষয়টি নিয়েই সংবাদমাধ্যমে নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্য়ান্ট জেনারেল এইচ এস পানাগ। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন টানা প্রায় ৪০ বছর! তাঁর আরও একটি পরিচয় হল, তিনি অভিনেত্রী গুল পানাগের বাবা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানকে জবাব দিতে ভারতের কী করা উচিত, এবং কী করা উচিত নয়, সেই বিষয়ে বিস্তারিত একটি প্রবন্ধ লিখেছেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্য়ান্ট জেনারেল এইচ এস পানাগ। 'দ্য প্রিন্ট'-এ তাঁর সেই লেখা প্রকাশ করা হয়েছে।
পানাগ প্রথমেই যুদ্ধ জিগিরের বিরোধিতা করেছেন। বদলে ঠান্ডা মাথায়, রয়ে-সয়ে কৌশলী পদক্ষেপের পক্ষে সওয়াল করেছেন। তাঁর বক্তব্য হল - প্রবল জাতীয়তাবাদের আবেগে ভর করে তাৎক্ষণিক কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানও একটি পরমাণু শক্তিধর দেশ। পরমাণু শক্তি সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই প্রাথমিকভাবে যেকোনও হামলার জবাব দেওয়ার পরিকাঠামো তাদের কাছে আছে।
পানাগ একথা উল্লেখ করেছেন যে দেশবাসী আবেগতাড়িত হয়ে দ্রুত প্রতিশোধ নেওয়ার দাবি তুলছে। কিন্তু, ফিল্ড মিসাইল হোক, কিংবা ড্রোন, অথবা আকাশপথে কিংবা নৌপথে হামলা চালানোর পরিকাঠামো, ভারতের কাছে যে প্রযুক্তি রয়েছে, তা যে একেবারে অপ্রতিরোধ্য, তা কিন্তু নয়। তাই, ভারত যদি সেই প্রযুক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে, তাহলে পাকিস্তানও তার জবাব দেবে। এবং ভারতকে তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
পানাগের মতে, এই হামলার তাৎক্ষণিক পালটা জবাব হিসাবে 'ফায়ার অ্য়াসল্ট' করা যেতে পারে। অর্থাৎ - একটি নির্দিষ্ট ও ছোট জায়গাকে টার্গেট করে জবাবি হামলা চালানো। যা হবে কৌশলী ও প্রভাবশালী।
এক্ষেত্রে স্পেশাল ফোর্সকে অভিযানে নামানো যেতে পারে। আকাশ পথে, ড্রোনের সাহায্য়ে এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা যেতে পারে। কিন্তু, সেটা স্বল্প পরিসরে। নিয়ন্ত্ররেখা বরাবর সেই সমস্ত স্থান, যেখানে লস্কর-ই-তৈবা বা জৈয়স-ই-মহম্মদের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘাঁটি রয়েছে, সেগুলিকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা যাতে পারে। এক্ষেত্রেও একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হবে। কিন্তু, সেটা বৃহৎ আকার নেবে না। ছোট ছোট একাধিক এলাকায় কৌশলগতভাবে সীমাবদ্ধ থাকবে। এবং এই হামলাগুলি সুপরিকল্পিতভাবে চালিয়ে যেতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্য়ান্ট জেনারেল এইচ এস পানাগের মতে, যেভাবে পাক অধিকৃত কাশ্মীর থেকে লাগাতার ছায়াযুদ্ধ চালানো হচ্ছে এবং যেভাবে পহেলগাঁও হামলা ঘটানো হয়েছে - নিরপরাধ,নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিকদের নিশানা করা হয়েছে, তার জবাবে ভারত যদি পরমাণু নিয়ন্ত্রণসীমার অধীনে থেকে এভাবে ছোট ছোট কৌশলী হামলা চালিয়ে যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক মহলও তার প্রতিবাদ করবে না।
কিন্তু, এই ধরনের হামলা অতর্কিতে করা দরকার। যখন শত্রুপক্ষ হামলার জন্য মোটেও প্রস্তুত থাকবে না। পাহাড়ে বরফ গলার পর যে সময়টা আসে, সেই সময়টাই এই ধরনের হামলা করার আদর্শ সময়। এবং জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে বলা যায়, পরমাণু অস্ত্র নিয়ে ময়দানে ঝাঁপানোর আগে এই ধরনের হামলা অনেক বেশি কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে।
এছাড়াও, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় ভারত পাকিস্তানকে আরও অন্তত ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার পিছন দিকে ঠেলে দিতে পারে। যে সমস্ত জায়গাগুলি ব্যবহার করে অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়, সেগুলি দখল করে নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে পাকিস্তান চাপে পড়ে যাবে। তারা শান্তির পথে সমঝোতা করতে বাধ্য হবে। কারণ, ভারত যদি নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে সামনের দিকে এগিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলির দখল নিতে পারে, তাহলে 'চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর'-এর উপর বিপদ ঘনিয়ে আসবে।
অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্য়ান্ট জেনারেল এইচ এস পানাগ মনে করেন, শুধুমাত্র রাজনৈতিক লাভের জন্য জনগণের আবেগ সামনে রেখে ভারতের মোটেও যুদ্ধের দামামা বাজানো উচিত নয়। বরং, কৌশলগতভাবে পাকিস্তানের উপর একের পর এক হামলা চালিয়ে যাওয়া উচিত। যা পাকিস্তানকে চাপে থাকতে বাধ্য করবে।