মীরাটে মার্চেন্ট নেভি অফিসার সৌরভ রাজপুত খুনের ঘটনায় উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তন্ত্র সাধনা, বলিউডে যাওয়ার স্বপ্নে বাধা, সৌরভকে খুনের মোটিভ হিসেবে সামনে আসছে একের পর এক ঘটনা। অন্যদিকে, দেহের পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে স্তম্ভিত আধিকারিকরা বলছেন, গত ৩০ বছরে এত নৃশংস ঘটনা দেখেননি তাঁরা দেখেননি।
সৌরভ হত্যার ক্ষেত্রে উঠে আসছে ব্ল্যাক ম্যাজিকের বিষয়ও। সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশ সুপার (শহর) আয়ুষ বিক্রম সিং জানিয়েছেন যে সৌরভের দেহাংশ দেখে সন্দেহ হয়েছিল যে কোনও তন্ত্র সাধনার যোগ থাকতে পারে, কিন্তু এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তাছাড়া পুলিশ জানতে পেরেছে যে, সাহিল নানারকম কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন। ‘আত্মা’-য় বিশ্বাস করতেন। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে মাদক এবং মদের নেশা চরম মাত্রায় পৌঁছায়।
রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিবেশীদের দাবি, মায়ের ‘আত্মা’-র সঙ্গে নাকি সাহিল কথা বলতেন। এমনই বিশ্বাস ছিল তাঁর। সাহিলের ঘরের দেওয়ালের একদিকে কালো রঙের পোস্টারে লেখা, ‘নমক সোয়াদ অনুসার, অকড় অওকাত অনুসার’। আরও এক জায়গায় আঁকা একটি মেয়ের অবয়ব। তাঁর ঠিক পাশেই ‘ভালবাসার চিহ্ন’। আরও এক জায়গায় একটি ‘ক্রস’ আঁকা। সেই ‘ক্রস’-এর চারপাশে লাল রং দিয়ে অদ্ভুত নকশা করা। তার ঠিক উপরেই কয়েকটি নম্বর। দেওয়ালের আরও এক জায়গায় ইংরেজিতে লেখা, ‘ইউ ক্যান্ট ট্রিপ’। সঙ্গে বিচিত্র একটি মুখের অবয়ব। তদন্তকারীরা আরও দেখেন, দেওয়ালের এক কোণে আঁকা দু’জনের হাত। কব্জি পর্যন্ত। একটি হাতে ধরা বিড়ি বা সিগারেট। হাতে লেখা, ‘পাফ পাফ পাস’।
রিপোর্ট অনুযায়ী, এছাড়াও ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেশার দ্রব্য। আরও আশ্চর্য, ঘরে একটা কালো বিড়ালও দেখতে পেয়েছেন তদন্তকারীরা। আর এই সব বিষয়ই সন্দেহ বৃদ্ধি করছে মার্চেন্ট নেভি অফিসার সৌরভ রাজপুতের খুনে অভিযুক্ত সাহিল কি ‘তন্ত্রসাধনা’ করতেন? তাঁর ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া বেশ কিছু রহস্যময় জিনিস সেই সন্দেহকে আরও বাড়িয়েছে। যদিও এখনও বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত নয় পুলিশ। তবে ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া জিনিসগুলি বাজেয়াপ্ত করেছে তারা।
এছাড়াও পুলিশ জানিয়েছে, ২০১৬ সালে সৌরভ ও মুসকান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রেমের সম্পর্ক পরিণতি পাওয়ায় খুব খুশি ছিলেন দু'জনে। স্ত্রীর সঙ্গে আরও সময় কাটানোর জন্য মার্চেন্ট নেভির চাকরি ছেড়ে বাড়িতে চলে আসেন। কিন্তু পারিবারিক অশান্তির কারণে এরপর বাড়ি ছেড়ে মুসকানকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করেন সৌরভ। ২০১৯ সালে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন মুসকান। কিন্তু ২০২১ সালে সৌরভ জানতে পারেন, সাহিলের সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িত মুসকান। বাড়িওয়ালা তাদের আপত্তিকর অবস্থায় দেখে নিয়েছিল।
জেরায় মুসকান বলেছে, ২০১৯ সাল থেকে সাহিলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক ঘিরে অশান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। ডিভোর্সের পথে এগিয়েও, সন্তানের কথা ভেবে পিছিয়ে আসেন সৌরভ। ফের মার্চেন্ট নেভির চাকরি নিয়ে ২০২৩ সালে ভিন দেশে চলে গিয়েছিলেন। মেয়ের ছ'বছরের জন্মদিন উপলক্ষে ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরেছিলেন সৌরভ। এরপরেই তাঁকে খুন করেন মুসকান এবং সাহিল। মুসকান দাবি করেছেন, সাহিল মদ্যপান করতেন, যার ফলে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। সাহিলও আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে ছিলেন।
এরই মধ্যে সৌরভের দাদা বাবলু রাজপুতের বয়ানে সামনে এসেছে এক বিস্ফোরক তথ্য। তিনি জানিয়েছেন, বিয়ের পর থেকে একাধিক বার বাড়ি থেকে মোটা টাকা চুরি করে নিয়ে মুম্বই পালিয়েছিলেন মুসকান। বলিউডে হিরোইন হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। সৌরভের দাদার দাবি, তাঁদের মধ্যে ডিভোর্সের কেস চলছিল। মার্ডারের পিছনে এমন কোনও মোটিভ ছিল কিনা, তাও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
পাশাপাশি পুলিশ জানিয়েছে, মুসকান দাবি করেছেন যে সৌরভের অ্যাকাউন্টে ৬ লক্ষ টাকা ছিল। সেই টাকা বাজেয়াপ্ত হতে পারে, এই ভয়ে তিনি তাঁর অ্যাকাউন্টে ১ লক্ষ টাকা এবং মায়ের অ্যাকাউন্টে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা ট্রান্সফার করেছিলেন। পুলিশ মুসকানের দাবি যাচাই করছে। সৌরভ কবে লন্ডনে গিয়েছিলেন এবং সেখানে কী কী করেছিলেন, তাও তারা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সৌরভের মার্চেন্ট নেভিতে চাকরি এবং স্কুলের বাইরে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যাননি বলে দাবি এখনও যাচাই করা হয়নি। সৌরভের মা রেণু দেবী বলেন, 'ওর মেয়ে প্রতিবেশীদের বারবার বলেছিল যে পাপা ড্রামের ভিতরে রয়েছে। তার মানে ও খুন এবং তার পরের ঘটনা জানত।' কীভাবে সৌরভের দেহ উদ্ধার হল, তার বর্ণনা করতে গিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে রেণু দেবী বলেন, 'মুসকান ও সাহিল আমার ছেলেকে খুন করে ঘুরতে চলে যায়। বাড়িওয়ালা আগেই ওদের ঘর ফাঁকা করে দিতে বলেছিল। যখন ওরা ফিরে আসে, বাড়িওয়ালা শ্রমিক পাঠায় ঘর সারাইয়ের জন্য। কিন্তু ঘরের ভিতরে রাখা ওই বড় নীল ড্রামটা কিছুতেই সরাতে পারছিল না ওরা। জিজ্ঞাসা করায় মুসকান বলেছিল, ড্রামে আবর্জনা রয়েছে। তবে ড্রামের ঢাকনা খুলতেই একটা পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ঘরে। যতক্ষণে পুলিশ আসে, ততক্ষণে মুসকান বাপের বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিল।'
এর আগে মুসকানের মা, কবিতা রাস্তোগিও বলেছিলেন যে মুসকানই সৌরভকে খুন করেছে। তাঁর কাছে অপরাধ স্বীকার করতেই তিনি পুলিশে অভিযোগ জানান। তাঁর দাবি, অভিযুক্ত সাহিলের সঙ্গে মাদকের নেশা করতেন মুসকান। সেই কারণে কখনও বাবার বাড়িতেও যেতে চাইত না।