হাসিনা সরকারের পতনের পর, আজ (বুধবার - ২৬ মার্চ, ২০২৫) বাংলাদেশের প্রথম 'মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস' পালিত হল। আর, এদিনই ফের একবার পড়শি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিসরে থাকা প্রধান দলগুলির মধ্য়ে (অন্তত প্রধান দু'টি দল) বিভেদ আরও প্রকট হয়ে উঠল। একের পর এক মন্তব্য, পালটা মন্তব্য - যা বাংলাদেশেরই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, তা থেকেই স্পষ্ট - নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে খালেদা জিয়ার বিএনপি এবং তরুণদের নিয়ে গঠিত এনসিপি!
এদিনের ঘটনাক্রম পরপর সাজালে দেখা যাবে - একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এর আগে নানা জনে নানা কথা বললেও দিনটি উদযাপনে কিন্তু সব পক্ষই সামিল হওয়ার চেষ্টা করেছে।
এদিন সকালে প্রবীণ বিএনপি নেতা এবং ঢাকা শহরের প্রাক্তন মেয়র মির্জা আব্বাসকে বলতে শোনা গিয়েছিল, 'আজকের স্বাধীনতা দিবস প্রমাণ করে, দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে বাংলাদেশে কিছু নেই। যাঁরা সেকথা বলেন, তাঁরা আজকের স্বাধীনতা দিবসকে খাটো করতে চান। একাত্তরের স্বাধীনতায় তাঁদের কোনও ভূমিকা ছিল না। সুতরাং, এই দিনটাকে তাঁরা খাটো করতে চান! আমি বলব, তাঁরা যেন এখানেই বিরত থাকেন। এই স্বাধীনতা দিবসকে যেন সম্মান জানান এবং সম্মান করেন।'
একইসঙ্গে, মির্জা আব্বাস জানিয়েছিলেন, তাঁরা বিশ্বাস করেন চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসেই বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হবে এবং তাঁরা আপাতত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উপর আস্থা রাখছেন।
তাঁর এই মন্তব্য নিয়ে পরবর্তীতে এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলামকে প্রশ্ন করা হয়। সেই নাহিদ, যিনি নয়া রাজনৈতিক দল গঠন করার আগে পর্যন্ত ইউনুস প্রশাসনের বেতনভুক উপদেষ্টা ছিলেন।
তিনি সাতচল্লিশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ এবং চব্বিশের জুলাই-অগস্টের অভ্যুত্থান নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। যার সারমর্ম হল - এগুলি সবই আসলে এক! তাঁর কথায়, 'চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান এবং আমাদের একাত্তরের সংগ্রাম, আমাদের সাতচল্লিশের আজাদির লড়াই - এই সবকিছুর ভেতর দিয়ে আমরা যে স্বাধীন, সার্বভৌম, মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র পেতে চেয়েছিলাম, তার একটি সুযোগ ও সম্ভাবনা আমাদের গণ–অভ্যুত্থানের পর তৈরি হয়েছে। একাত্তরের স্বাধীনতা ও চব্বিশের স্বাধীনতা পরস্পরবিরোধী নয়, আমরা সেই ধারাবাহিকতাতেই আছি।'
এর পাশাপাশি নাহিদ ইসলাম আবারও একবার পুনরায় নির্বাচনে যাওয়ার আগে সংস্কারের উপর জোর দেন এবং বুঝিয়ে দেন সংস্কার না করে নির্বাচন 'চাপিয়ে দেওয়া হলে' তাঁরা এবং তাঁদের দল সেটা মানবে না!
তিনি বলেন, 'কেবল কোনও একটি দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য (যদি) নির্বাচন চাপিয়ে দেওয়া হয় সংস্কার ও বিচার ছাড়া, তাহলে তা অবশ্যই মেনে নেওয়া হবে না।'
এই প্রেক্ষাপটে 'সমকাল' নামে বাংলাদেশের একটি সংবাদমাধ্যমকে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দেন বিএনপি-র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁর প্রত্যেকটি কথায় মির্জা আব্বাসের কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় এবং সেটা আরও জোরালভাবে। একইসঙ্গে, তাঁর মতামতের সঙ্গে নাহিদ ইসলামের মতামতের বিস্তর ফারাকও ধরা পড়ে।
অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে মির্জা ফখরুল বলেন, 'একাত্তর ও চব্বিশ সমান - এটি মূলত তাঁরাই বলেন, যাঁরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেনি। উলটে একাত্তরের হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করেছেন! তাঁদের কেউ কেউ এখন গলা উঁচিয়ে বলার চেষ্টা করছে যে ১৯৭১ সালে কিছু হয়নি। কিছু কিছু দল বোঝানোর চেষ্টা করছে, মুক্তিযুদ্ধ কোনও ঘটনাই ছিল না।'
তিনি আরও স্মরণ করিয়ে দেন, 'ধীনতা দিবস বরাবরই আমাদের কাছে একটি গৌরব ও তাৎপর্যময় দিন। ২৬ মার্চ হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুর দিন। স্বাধীনতা ঘোষণার দিন। আমরা যে বঞ্চনার শিকার হয়েছি, তার বিরুদ্ধে লড়াই শুরুর দিন।'
তবে, ইতিহাসকে স্মরণ করার পাশাপাশি একইসঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে শেখ মুজিবর রহমানের অবদান উড়িয়ে দিয়ে বিএনপি-র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকেই সামগ্রিক কৃতিত্ব দিয়েছেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, '২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই দেশের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। হত্যা করেছে লাখো নিরীহ মানুষ। সেই সময়ে যিনি পূর্ব পাকিস্তানের নেতা ছিলেন, তিনি তখন আত্মসমর্পণ করেছিলেন। বাঙালি দিশেহারা ছিল। সে সময়ে একজন অখ্যাত মেজর বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করার ডাক দিয়েছিলেন। সবাই সাহস নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দেশ স্বাধীন হয়েছিল। আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশ। বিপরীতে চব্বিশ হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াই। দেশকে স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদমুক্ত করার লড়াই। তাই একাত্তর ও চব্বিশকে তুলনা করার কোনও সুযোগ নেই। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।'
তাঁর স্পষ্ট বার্তা, শেখ মুজিবুর রহমান হোক, কিংবা তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা - তাঁরা কোনও দিনই জাতির নেতা বা নেত্রী হয়ে উঠতে পারেননি। বদলে শুধুই নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবেছেন। মির্জা ফখরুলের কথায়, 'একাত্তরে শেখ মুজিব অন্য কারও চিন্তা না করে নিজে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। আবার চব্বিশে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন। নিজ দলের নেতাকর্মীকে নিয়ে কোনও ভাবনা দেখা যায়নি। এটাই এদের চরিত্র। জনগণ যখন ক্ষেপে ওঠে, তখন ওরা এভাবে কর্মীদের অরক্ষিত রেখে পালিয়ে যায়।'
এছাড়াও, সংশ্লিষ্ট সাক্ষাৎকারে আরও চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন মির্জা ফখরুল। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, একাত্তরে পাকিস্তান যে নারকীয় আক্রমণ করেছিল, তার জন্য তারা আজও ক্ষমা চায়নি। বর্তমানে সেই ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা চলছে, তার প্রতিবাদ করেছেন বিএনপি-র মহাসচিব।
এর পাশাপাশি তিনি স্পষ্ট করেছেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তাই তাদের নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি যারা করছে, তারা আদতে ফের বাংলাদেশকে অশান্ত করতে চাইছে এবং বিএনপি এই চক্রান্ত সফল হতে দেবে না।
তৃতীয়ত, আওয়ামী লিগ নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও তাদের নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত জনতার হাতেই ছাড়ার কথা বলেছেন মির্জা ফখরুল।
এবং সবশেষে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, সংস্কার কোনও নতুন জিনিস নয়। বহু বছর আগে বিএনপি সুপ্রিমো খালেদা জিয়াই সেই পথ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু, দেশকে সুস্থির করতে এবং মানুষকে সুপ্রশাসন ফিরিয়ে দ্রুত নির্বাচন জরুরি। যা একেবারেই এনসিপি-র মতামতের উলটো কথা!