- সাবির আহমেদ
প্রতীচী (ইন্ডিয়া) ট্রাস্ট’-এর ন্যাশনাল রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর, গবেষক
ভারতবর্ষের সমাজে মহিলাদের জীবনযাপন তো অনেকটাই ছকে বাঁধা। সেই নিরিখে সোফিয়া নিঃসন্দেহে ছক ভাঙা লড়াকু এক নারী। একজন মহিলা আর্মি অফিসার বলে নয়, দেশের জন্য কাজ করার তীব্র ইচ্ছে তাঁর মধ্যে বরাবর দেখেছি। ২০২১ সালে সোফিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ হয় একটি কাউন্সেলিং সেশনের মাধ্যমে। তার পর মাঝে মাঝেই কথা হত। সামনাসামনি বেশি কথা হয়নি, মূলত হোয়াটসঅ্যাপেই। একজন নারী হিসেবে সোফিয়া বরাবর ভীষণ সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী। ওর ব্যক্তিত্বের এই গুণ যে কাউকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
- কেরিয়ার কাউন্সেলিং সেশন
কোভিডকালে তখন আমরা সকলেই ঘরবন্দি। অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছিল জীবনের সব ক্ষেত্রে। চাকরিবাকরি নিয়েও। অনলাইনে কেরিয়ার কাউন্সেলিং সেশন করার কথা তখনই মাথায় আসে। পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু বিত্ত নিগম থেকে একটি পরিকল্পনা হয়। সেই পরিকল্পনার অধীনে এক এক করে মোট ৯৯টি ভিডিয়ো করা হয়েছিল। সবকটিই এখন ইউটিউবে উপলব্ধ। দেশের নানা প্রান্তের বহু আইপিএস, আইএএস অফিসাররা যোগ দিয়েছিলেন সেশনগুলিতে। যোগ দিয়েছিলেন পাইলট, অধ্যাপকসহ অন্যান্য পেশার লোকজনও। সেখানেই এসেছিলেন সোফিয়া। ২০২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইউটিউবে ভিডিয়োটি সম্প্রচারিত হয়।
- ঐতিহাসিক রায়ের অংশ ছিল সোফিয়া
আজ নারীশক্তি নিয়ে সারা দেশ কথা বলছে, এ খুব সুখকর অনুভূতি। কিন্তু আমাদের দেশে সেনা, আমলাতন্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে মহিলাদের আগে সেভাবে দেখা যেত না। অথচ শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, এমনকি তালিবান শাসনের আগে আফগানিস্তানেও শীর্ষ স্থানগুলিতে মহিলারা ছিলেন। আজ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের নারীশক্তির মধ্যে যাঁরা অগ্রণী, তাঁদের মধ্যে সোফিয়া অন্যতম। সুপ্রিম কোর্টের ২০২০ সালের রায়ের পর সোফিয়ার মতো আর্মি অফিসাররা স্থায়ী কমিশন পেয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। শীর্ষ আদালতের ওই রায়ে সোফিয়ার উদাহরণ টেনেছিলেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। আন্তর্জাতিক সামরিক মহড়ায় ভারতীয় সেনাদলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন সোফিয়া। আবার, কঙ্গোতে ২০০৬ সালে শান্তিরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে তাঁকে পাঠিয়েছিল রাষ্ট্রসংঘ। ঐতিহাসিক সেই রায়ের অংশ ছিল সোফিয়ার এইসব সাফল্য।
- কেরিয়ার কাউন্সেলিং নিয়ে সোফিয়ার পরামর্শ (সোফিয়ার কথা শোনা যাবে ২০ মিনিট থেকে)
- সোফিয়ার আরেক পরিচয়
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর থেকে সোফিয়ার আরেকটি পরিচয় বারবার উঠে আসছে। সেটাই ভারতবর্ষের বৈচিত্র্য ও উদারতার পরিচয় বহন করে। একটি সংখ্যালঘু পরিবার থেকে এসে মেয়েটি এই স্থানে পৌঁছেছে। প্রাচীন ধ্যানধারণার ছক ভাঙার সাহস আর ক্ষমতা দুটোই তাঁর মধ্যে রয়েছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। চার বছর আগের সেই লাইভ অনুষ্ঠানেও উনি মেয়েদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘কিছু লোক আছেন, যাঁরা বলেন, মেয়েরা এই পারে না, ওই পারে না। কিন্তু তাদের দূরে সরিয়ে রাখো। তাঁদের কথা বেশি ভেবো না। ইতিবাচক কথা বেশি করে ভাবো।’ কীভাবে পড়াশোনা করতে হবে, কীভাবে নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে, সে নিয়েও পড়ুয়াদের পরামর্শ দিয়েছিলেন সোফিয়া। বলেন, ‘২৪ ঘণ্টা সবাই পায়, তুমিও পাচ্ছ। সেইসময়কেই কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সেদিক নিয়ে ভাবতে হবে। লক্ষ্য পূরণ করতে হলে কিছু কাজ করতে হয়। সেগুলি কাজগুলি এই সময়ের মধ্যে নিয়ম করে করতে হবে।’ মেয়েদের সঙ্গে যেচে আলাপ করেছিলেন। বারবার বলেছিলেন, সেনাদলে আরও বেশি করে মেয়েদের যোগদান প্রয়োজন।
- লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা
হোয়াটসঅ্যাপে সোফিয়ার সঙ্গে বেশি কথা বলা হত না কারণ ওর নিরাপত্তাজনিত নানা দিক। পাঠকরা আশা করি বুঝতে পারবেন। তবে শুধু পড়ুয়াদের নয়, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন আমাকেও। এই কেরিয়ার কাউন্সেলিং সেশন নিয়ে আমাকে বলেছিলেন ‘You are effectively using this time (অর্থাৎ কোভিডের এই সময়কে আপনি খুব সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করছেন)’। এমন তারিফ তো আরও বেশি করে কাজ করার, লড়াই করার অনুপ্রেরণাই দেয়!
প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব
(অনুলিখন - সংকেত ধর)