এসে গেল বাঙালীর অপর উত্সব কালীপুজো। আর কালীপুজো মানেই তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ভূত-প্রেত ইত্যাদি। মা কালীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় দুই ভয়ঙ্কর রাক্ষস নারীকে। হ্যাঁ ডাকিনী-যোগিনী। দেখে যে কেউ ভয় পেতেই পারেন। এনারা কী শুধুই মা কালীর সঙ্গী? নাকি পিছনে লুকিয়ে রয়েছে কোনও বড় ইতিহাস? সত্যিই কী তাঁরা এতটাই নিষ্ঠুর?
ভারতীয় উপমহাদেশের আদিম ধর্ম তন্ত্র উপাসনার ধারার মাতৃকা এই ডাকিনী যোগিনীদের সম্পর্কে আমাদের নানা ভুল ধারণা রয়েছে। অথচ আমাদের দেশেই রয়েছে ৬৪ যোগিনীর মূর্তি, নানা মন্দিরে স্থাপত্যে রয়েছে ডাকিনী যোগিনীর দেবী মূর্তি।
মায়ের অনেক রূপ। এর মধ্যে দেবী দক্ষিণাকালীর প্রচলিত পূজাপদ্ধতি থেকে জানা যায়, মূল দেবতার পূজার পর পূজিত হন মায়ের সহচরীরা। এইসময়ই পুজো করা হয় ডাকিনীগণ ও যোগিনীগণকে। এঁরা মূলত: দুটি শ্রেণী বা গোষ্ঠী- ডাকিনীগণ, যোগিনীগণ।
যোগিনী কারা?
মহাভারতের অন্তর্গত ভগবদগীতার আঠেরোটি অধ্যায়ের নামের সঙ্গেই 'যোগ' শব্দটি রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, অষ্টাঙ্গযোগ, ভক্তিযোগ প্রভৃতি নানাবিধ যোগপথের মাহাত্ম্যকে গ্রহণ করে অর্জুনকে যোগী হবার উপদেশ দেন। বৈষ্ণব চতু:সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যাতে ভক্তিযোগকে এই সমস্ত যোগপন্থার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে লাভের সাধনা মাত্রেই কোনও না কোনও যোগসাধনা। যাঁরা যোগ-অন্ত প্রাণ, তাঁরাই যোগী, স্ত্রীলিঙ্গে যোগিনী।
যোগের তাৎপর্য কী তাহলে? পন্ডিতদের মতে জীব ও আত্মার ঐক্যই যোগ।আবার আগমবেত্তারা বলেন, শিবশক্ত্যাত্মক জ্ঞানই হলো যোগ। শাস্ত্র অনুযায়ী এইভাবেই যোগের নানা রকম তাৎপর্য নিহিত হয়।
উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে ৬৪ যোগিনীর মন্দির দেখা যায়। আর এখন তা ভ্রমণের স্থানও বটে। মন্দিরের কেন্দ্রে থাকেন শিব, আর তাঁকে ঘিরে থাকেন যোগিনীরা।
ডাকিনী কারা?
ডাকিনী শব্দের বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। তন্ত্রসাধনায় এই ডাকিনী হলেন একজন শক্তিশালী, অতি ভয়ঙ্কর অপবিদ্যার দেবী। শাস্ত্র অনুসারে ডাকিনী একজন দেবী। তাঁর জলন্ত মূর্তি খুবই উগ্র এবং জলন্ত অগ্নিপিণ্ডের মতো।এনার ৩টি চোখ, রক্তাত দাঁত এবং মাথায় রয়েছে জটা। আমাদের কুণ্ডলিনী চক্রের প্রথম চক্রে অর্থাত্ মূলধার চক্রে ডাকিনীর অবস্থান। সাধকের এই চক্র উন্মোচন হলে তিনি ডাকিনী শক্তি লাভ করেন। এদের অলৌকিক শক্তি প্রবল হয়।
বাংলা ব্যাকরণ ভাষায় ডাক হলো পুংলিঙ্গ এবং ডাকিনী স্ত্রীলিঙ্গ। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, ডাক ও ডাকিনী বলতে, তন্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ কোনও বৌদ্ধ সন্নাসী ও সন্নাসিনীকে বোঝায়। উত্তর কাশ্মীরের বেশ কিছু সাধকেরা ডাকিনীকে জ্ঞান, বিদ্যার দেবী হিসাবে পুজো করতেন।অপরদিকে তিব্বতি ভাষায় ডাকিনী শব্দের অর্থ জ্ঞান। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আরও বলেন ডাকিনীরা ছিলেন খুবই জ্ঞানী। এই যুগের ডক্টরেটের মত সেই সময় ডাকিনী বা জ্ঞান ছিল সম্মানীয় উপাধি। তাহলে ভয় কিভাবে এলো। শোনা যায়, অরাজকতার যুগে কিছু গোঁড়া ব্রাহ্মণ, সমাজে তাঁদের ক্ষমতা বা প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে এই সকল শিক্ষিত বা জ্ঞানী নারীদের ডাইনি/ ডাকিনী বা অপদেবী সন্দেহে তাঁদের অপমান করে সমাজ থেকে বহিষ্কার করে। আর সেই থেকেই এই ডাকিনীকে খারাপ চোখে দেখতে শুরু করে মানুষ। আজ ও বহু গ্রামে এই ডাইনি নাম দিয়ে বহু মহিলাদের উপর অকারণ এবং যুক্তিহীনভাবে মারধোর করা হয়।