সৌকর্য্য সামাদ
অতিথি অধ্যাপক, রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক কলেজ, নরেন্দ্রপুর
‘ইতিহাসে হাতেখড়ি’ সিরিজ, ইন্সটিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতার তরফে এক অনন্য প্রয়াস। এই সঙ্কলনে নতুন সংযোজনা – ‘খাওয়াদাওয়া’, ‘খেলাধুলো’ ও ‘পোশাক-আশাক’ – মানবজীবনের আপাতসাধারণ অথচ অতিপ্রয়োজনীয় অঙ্গগুলি নিয়ে ছোটদের জন্য লেখা সময়োপযোগী তিনটি বই। এ কথা নিঃসন্দেহের যে, প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চার জগতে ভাষার অতিরিক্ত মারপ্যাঁচ ও দুর্বোধ্যতাই যেখানে রীতি, সেখানে প্রাঞ্জলভাবে ইতিহাসকে ভাবী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরবার এই সুচিন্তিত প্রচেষ্টা বিশেষ সাধুবাদ প্রাপ্য।
খাওয়া–দাওয়া

কথায় আছে, ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’ অর্থাৎ খাদ্যকষ্টের পাশে বাকি সব তুচ্ছ। এই খাওয়াদাওয়ার জন্যই পৃথিবীতে যত দ্বন্দ্ব, যত সর্বনাশ। কে খাদ্য, কে খাদক এবং তার বণ্টনের উপর দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের বিশ্বব্যাপী আর্থসামাজিক পরিকাঠামো। আবার খাদ্য মানুষের মেলবন্ধনের সেতুও বটে। সেই ইতিহাস সংক্ষিপ্ত পরিসরে ৯ থেকে ১৪ বছরের শিশু–কিশোরদের উপযোগী করে লিখতে পারা মোটে সহজ নয়। আলোচ্য গ্রন্থে সেই অসাধ্য সাধন করেছেন অধ্যাপিকা অন্বেষা ও সীমন্তিনী।
আমাদের ও প্রতিবেশী দেশ গুলির বিভিন্ন খাদ্যাভ্যাসকে তুলে ধরতে, সুকুমার রায়ের ছড়ার অবতারণা ঘটে প্রথম ভাগেই। ফরাসিদের ব্যাঙ, জাপানিদের ফড়িং কিংবা ছোটবেলা থেকে শুনে আসা চিনেদের আরশোলা খাবার রীতি – কোনওটিই যে বিসদৃশ নয়, বরং বিভিন্ন মানুষের থাকার জায়গা, আর্থিক ক্ষমতা ও স্বাদকোরকের উপর নির্ভরশীল, তা বোঝানো হয়েছে মজার ছলে। এই বৈচিত্র্য আবার জাতি-গোষ্ঠী বিভাজনেরও কারণ হয়ে ওঠে। এমন ভাবেই কথায় কথায় অনায়াসে আনা হয়েছে রন্ধনশিল্পে লিঙ্গবৈষম্য ও শ্রেণি-বৈষম্যের প্রসঙ্গ। ‘রান্না তো মেয়েদের কাজ’ বা ‘রান্নাঘর মহিলামহল’ – এই চিরাচরিত পুরষতান্ত্রিক অভ্যেস বা ধারণা যে ভুল তা শিশুকাল থেকে জানা ও বোঝা আবশ্যক ।
চাল ও গমের দ্বন্দ্ব, খাবারের উপর ভিত্তি করে ঔপনিবেশিক বিভাজন নীতি কিংবা পুষ্টিগুণের চেয়েও বড় হয়ে ওঠা ধর্মীয় বিধান - খাদ্য রাজনীতির এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ উঠে এসেছে বইটির ছত্রে ছত্রে। হিন্দু হোক বা মুসলমান, পাক-আহার নিয়ে যতই রীতি নীতি মানুক না কেন, খিদের সামনে সবাই সমান। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরে একটু ফ্যানের জন্য হাহাকার, দেশভাগ পরবর্তী প্রবল খাদ্যাবভাব অথবা ১৯৬৬-এর খাদ্য আন্দলনের ফলে বাংলায় কংগ্রেস সরকারের পতন সবই যেন অন্নের অপরিহার্যতার দগদগে প্রমাণ।
কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া শাহিনবাগের নাগরিকত্ব বিল বিরোধী আন্দোলন আর কোভিড চলাকালীন বিপর্যস্ত মানবসমাজকে একই সুরে বাঁধে সমবায় ক্যান্টিনগুলির কুর্ণিশযোগ্য প্রচেষ্টা। তাই এত বিভেদের মাঝে মিলনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তগুলির উপর বারবার জোর দিয়েছেন লেখিকারা। স্বাস্থ্যই সম্পদ। সেই সম্পদ আগলাতে প্রয়োজন পুষ্টিকর সুখাদ্যের। তাই খাবারের কোন ধর্ম নেই, জাত নেই, তার রন্ধনক্রিয়ার দায়িত্ব শুধু নারীর উপর বর্তায় না। আগামীর সুন্দর, বিদ্বেষমুক্ত পৃথিবী গড়ার জন্য সবচেয়ে জরুরি হল খাদ্যের সুষম বণ্টন।
খেলাধুলো

শিশুদের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কী? নিঃসন্দেহে খেলাধুলো। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের মুঠোভাষ অর্থাৎ মোবাইল ব্যবহার বেড়ে চললেও, খোলা মাঠের কোনও বিকল্প নেই আজও। সেই সবুজ ঘাসের নিবিড় আশ্রয়ে গড়ে ওঠে এক অন্য জীবনবোধ। বিভিন্ন খেলার সঙ্গে দেশ ও জাতিচেতনার যে ওতপ্রোত যোগাযোগ, ছোটবেলা থেকে সেই সম্পর্কে ধারণা তৈরি হওয়া জরুরি। আলোচ্য বইটি তে অনীক বিশ্বাস ও কৌস্তভ মণি সেনগুপ্ত খুব ছোট গণ্ডির মধ্যে সেই চেষ্টাই করেছেন।
‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’। অতএব, সেই খেলার মাধ্যমে, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ দিয়ে এই গল্পের শুরু। তেজিয়ান তরুণ নগেন্দ্রপ্রসাদ, ফুটবলকে সার্বজনীন করতে গিয়ে লড়েছেন ইংরেজ প্রভু ও বর্ণহিন্দু গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করেই ১৯১১ সালে বিদেশীদের বিরুদ্ধে মোহনবাগানের শিল্ড জয়, পরাধীন ভারতে ঔপনিবেশিক আস্ফালনের গালে এক সপাট চড়। একশ বছর পার করেও সেই কাহিনী, আট থেকে আশি সবার মনে অদ্ভুত আলোড়ন তুলতে সক্ষম।
তবে আমাদের অতীত যে কেবলই গৌরবময়, তা নয়। ইস্ট–মোহনের চিরাচরিত বাঙাল–ঘটি দ্বন্দ্ব, মহামেডানকে ঘিরে তিরিশের দশকে সাম্প্রদায়িক বিভাজন অথবা জাতের ভিত্তিতে দল নির্বাচন, এ সবই যে আমাদের মানসিক দৈন্যের পরিচায়ক তা বোঝাতে সচেষ্ট হয়েছেন লেখকেরা। ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও এর অন্তরায় ঘটেনি। ‘দলিত’ হওয়ার ‘অপরাধে’ বম্বে ক্রিকেটের বিখ্যাত পালওয়ানকর ভাইদের, সতীর্থদের হাতেই বিবিধ হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয়। তারপর গঙ্গা দিয়ে গড়িয়েছে বহু জল। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ভারত, চারবার মাথায় পড়েছেবিশ্বজয়ের শিরোপা। তবু অন্ধকার কেটেছে কি? আজও বিভিন্ন প্রাদেশিক লবির সুপারিশে, কিম্বা ধর্মের ভিত্তিতে দলে সুযোগ পাওয়া ও বাদ পড়ার অভিযোগ প্রায় শোনা যায়।
ক্রিকেট, ফুটবল ছাড়াও অলিম্পিকে আটটি সোনা জয়ী ভারতীয় হকি দলের কথা বিশেষ ভাবে উঠে এসেছে লেখাটিতে। খেলার জগতে লিঙ্গভেদের প্রচলনকে খর্ব করে মহিলা তারকাদের আত্মপ্রকাশ অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ। তাই সচিন, গাভাসকার, অভিনব বিন্দ্রাদের পাশাপাশি এই বইয়ে সসম্মানে জায়গা করে নিয়েছেন ঝুলন গোস্বামী, মেরি কম, পি ভি সিন্ধুরা। শেষ ক’টি অলিম্পিকে, ভারতের সাফল্যের খাতায় মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সমান অংশীদার। বইটির শেষ অংশে ষোল গুটি খেলাটির সচিত্র বর্ণনা মনোগ্রাহী। তবে বইয়ে এটিকে দাবার গ্রাম্য সংস্করণ বলা হলেও, চাইনিজ চেকারস খেলাটির সঙ্গে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায় বলেই ধারণা।
খেলা যে জয়-পরাজয়ের গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে, এককে অনেকের সঙ্গে সহাবস্থানের মন্ত্র শেখায়, এই মূলভাব ধ্বনিত হয়েছে বইটির ছত্রে ছত্রে। ‘দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’ – এর চেয়ে উন্নততর শিক্ষা আর কিছু হয় না।
পোশাক–আশাক

দেবকুমার ঝাঁজ ও দেবারতি বাগচীর বইটিতে প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে ‘শাসনের পোশাক’ সম্পর্কিত তথ্য-সমৃদ্ধ, ঝকঝকে আলোচনা। মানুষ যে প্রায়শই, অন্তরের উৎকর্ষেরের চেয়ে বাইরের জাঁকজমককে বেশি গুরুত্ব দেয়, সে কথা বলাই বাহুল্য। মহেঞ্জোদারোর উপাসক-রাজার আবক্ষ থেকে স্কন্ধকাটা কুশাণ রাজ কনিস্কর মূর্তি প্রমাণ করে দেয়, সামাজিক-রাজনৈতিক ধার ও ভার জামাকাপড়ের আড়ম্বরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। গায়ের আচ্ছাদন, লজ্জা নিবারণ ও রুক্ষ আবহাওয়ার থেকে বাঁচার জন্য উদ্ভূত হলেও – কালে কালে তার ব্যবহার ও গুরুত্ব জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে।
ভারতে ব্রিটিশরাজের বানিজ্যিক শোষণের অন্যতম হাতিয়ার ছিল দেশজ তাঁত শিল্প কে ধ্বংস করে নিজেদের মেশিন নির্মিত কাপড়ের চাহিদা বাড়ানো।রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী সমাজের স্বপ্ন কিংবা গান্ধীর চরকা কেটে খাদির বস্ত্র নির্মাণ এর নির্দেশ - এই অন্তহীন শোষণকে রোখার পন্থা হিসেবে সেগুলির গুরুত্ব – এ সবই উপজীব্য হয়ে উঠেছে এই বইটির।
পুরুষশাসিত সমাজে নারীশরীরের উপর কর্তৃত্ব ফলানোর উপায় পোশাক নিয়ে একাধিক বিধিনির্দেশ। আব্রু বেআব্রুর সীমা নির্মাণ করে, মেয়েদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা কতটা নিন্দনীয় তা বিশদে আলোচনা করা হয়েছে। ছোট ছোট গল্পের আদলে শিশুমনের কাছে সহজভাবে ব্যাক্ত করা হয়েছে পোশাকের রাজনীতির জটিল স্তরবিন্যাস।
কবি বলেছেন ‘সহজ কথা যায়না বলা সহজে’। সে অমোঘ সত্য। কিন্তু আমরা যারা কলমচারি নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতেই বোধয় কখনও চেষ্টা করে দেখিনি – সহজ কথা যায় কি বলা সহজে? সমস্ত দোষগুণের পরিধির বাইরে গিয়ে এই সংকলন সেই চেষ্টা করবার সাহস দেখিয়েছে। কতটা সফল হয়েছে তার মূল্যায়ন করবে কচিকাঁচারা – যাদের জন্যে বইগুলি লেখা। তবে পটচিত্রের আদলে আঁকা রঞ্জিত ও সিরাজউদ্দৌলা চিত্রকরের অলঙ্করণ যে তাদের মন জয় করবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ইতিহাস শুধু অতীত নয়। ইতিহাস আবহমান। ইতিহাস কে কোনো নিগড়ে বাঁধা অসম্ভব। তাকে দুর্জ্ঞেয় শব্দ রাশির আড়ালে ঢেকে না ফেলে, স্বচ্ছ আখরে ধরতে চাওয়াতেই ‘ইতিহাসে হাতেখড়ি’ সিরিজের সার্থকতা।