HT Bangla Special: রাজসভা থমথমে, সকলে বিস্মিত আবার অভিভূতও। রাজার দৃষ্টি সপ্রশংস। সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সাধুবাদ জানালেন বিক্রমাদিত্য। মাঝে মাঝেই তাঁর মনে উদ্ভট প্রশ্নসঞ্চার হয়। আর উত্তর দেওয়ার ভার পড়ে সভার নবরত্নদের উপর। কিন্তু আজ যে উত্তর তাবড় তাবড় ‘রত্ন’রা দিতে পারলেন না, সে উত্তরই দিলেন এক নারী! আয়াসহীনভাবে। জনশ্রুতি, ওই নারী গণিত ও জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী। কিন্তু বরাহ-মিহিরও তো এই দুই শাস্ত্রে কম পারদর্শী নন। রাজার প্রশ্নে তাঁরা নিরুত্তর ছিলেন। শেষমেশ নারীটির জ্ঞান-দক্ষতার কাছেই নতিস্বীকার করলেন বরাহ।
আগেও এমনটা হয়েছে। অনেককেই বাক্যহীন করে দিয়েছে এই নারীর উত্তর। কিন্তু বিক্রমাদিত্যের আজকের প্রশ্ন ছিল কঠিন— ‘আকাশে কতগুলো নক্ষত্র?’ বরাহ-মিহির ব্যর্থতা স্বীকার করতেই গণনা করে বলে দিলেন লীলাবতী, সিংহলরাজের কন্যা। এর থেকেও গুরুতর পরিচয় তিনি বরাহের পুত্রবধূ, মিহিরের স্ত্রী। পুত্রবধুর পাণ্ডিত্য বরাহকে গর্বিত করে না, বরং মনের ভিতর জারিয়ে দেয় ক্রোধ ও খ্যাতি হারানোর ভয়। স্পষ্টত আজ রাজা ভীষণ প্রীত। তাঁর বহু প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিয়েছেন লীলাবতী। তাই বরাহের পুত্রবধূকে আজ দশম রত্ন হওয়ার প্রস্তাবও দিলেন। ওই মুহূর্তেই চরমে পৌঁছাল স্বামী-শ্বশুরের পুরুষালি ঈর্ষা। বাড়ি ফেরার পর পুত্রকে নির্দেশ দিলেন বরাহ— ‘জিহ্বা কর্তন করো লীলাবতীর’। আদেশ শুনে চমকে উঠলেও প্রতিবাদের সুযোগ নেই। শুধু একটা অনুরোধ রাখলেন লীলাবতী। জিভ কেটে নেওয়ার আগে কিছু কথা বলতে চান। ‘মৃত্যু’র আগে শেষ ইচ্ছের মতো তাঁর ওই কথাগুলি একজন শুনে কণ্ঠস্থ রাখলেন। পরমুহূর্তে কাটা পড়ল জিভ। লীলাবতী খোনা বা খনা হলেন। আর শেষ কথাগুলি হয়ে রইল ‘খনার বচন’।
আরও পড়ুন - HT Bangla Special: পড়ে যেতে যেতে সামলে নেওয়া…, বাঙালি জীবন যখন সাইকেলের খণ্ডকাব্য
ইতিহাস-কিংবদন্তির যুদ্ধ ছাপিয়ে
অনেকে মনে করেন, উপরের কাহিনিটি ইতিহাসনির্ভর নয়, কিংবদন্তি (লোকের মুখে মুখে প্রচলিত ইতিহাস)। কিন্তু ইতিহাস হোক বা কিংবদন্তি, খনার অস্তিত্ব কেউই সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারেনি। নেপথ্যের কারণ তাঁর পাণ্ডিত্য ও জ্ঞান। উড়িষ্যার প্রবাদ ধরলে, লীলাবতীই বাকরুদ্ধ হয়ে খোনা বা খনা হন। বাংলার প্রবাদ অনুসারে, লীলাবতীই ক্ষণা (শুভক্ষণে জন্ম বলে) শব্দের অপভ্রংশে খনা নামে পরিচিতা। খনার জন্মবৃত্তান্ত, স্বামী ও সময়কাল নিয়ে বহু মত থাকলেও দ্বিমত নেই তাঁর পাণ্ডিত্য ও শাস্ত্রজ্ঞান নিয়ে। প্রাচীন বাংলা তথা ভারত যে কয়েকজন বিদুষী নারীর নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে, সেখানেই যোগ্য স্থান পেয়েছেন খনা মতান্তরে লীলাবতী।
বাংলার ‘নারী’সম্পদ
বাংলার প্রথম নারী কবি কে? অনেকেই ইতিহাস হাতড়াবেন এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। কিন্তু বাংলার আদি লোকশাস্ত্র এই সুযোগ্য পদ দিয়েছে খনাকে। বাংলার প্রথম নারী কবি ছাড়াও তিনি বঙ্গদেশের প্রথম নারী জ্যোতিষবিদ, প্রথম নারী গণিতজ্ঞ, এমনকি প্রথম নারী কৃষিবিদ ও পরিবেশবিদও! কিংবদন্তি অনুসারে, খনার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা প্রশংসিত হয়েছিল বিক্রমাদিত্যের রাজসভায়। এসেছিল দশম রত্ন হওয়ার প্রস্তাব। কিন্তু তার আগেই স্বামী ও শ্বশুরের পাশবিকতার শিকার এই বিদুষী খনা। তাঁর বচনগুলি প্রবাদ আকারে এখনও প্রচলিত গ্রামবাংলায়। জানা যায়, তাঁর আমলে অন্যান্য বহু কবিদের থেকেই পারদর্শিতায় ছাপিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর ছড়ার কাব্যরীতি, ছন্দ, শব্দচয়ন আজও বহু পণ্ডিতদের অবাক করে। এছাড়াও, ‘অঙ্কস্য বামা গতি’র (অর্থাৎ যেকোনও সংখ্যার অঙ্কগুলি বামদিক থেকে ডানদিকে গণনা করতে হবে) মতো ছোট ছোট সূত্রে বেঁধেছিলেন গণিতের নানা তত্ত্ব।
আরও পড়ুন - ১৫০বছরের বৃদ্ধ হলেও ভবিষ্যতের যোগ্য সঙ্গী! কলকাতার ট্রাম-যাপন কি টিঁকবে আদৌ? আজ তার জন্মদিন

কেন আধুনিক?
শুধু বাংলায় নয়, খনার বচন প্রচলিত ও প্রশংসিত দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ও নেপালেও। আসাম, বিহার, উড়িষ্যার কৃষিমহলে তুমুল জনপ্রিয় এই প্রাজ্ঞ নারীর বচন। লোকমুখে বহু ছড়া প্রচলিত থাকলেও খনার ছড়া আলাদাভাবে চেনা যায় ভাষা ও বিষয়ের স্বকীয়তার জন্য। কৃষিবিজ্ঞানের প্রাথমিক নানা সূত্র নিহিত খনার বচনে। বচনে স্থান পেয়েছে গণিত ও জ্যোতিষশাস্ত্র। খনার অধিকাংশ বচনই কৃষিবিদ্যা, আবহাওয়া, গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র বিষয়ে। গ্রামেগঞ্জে আপ্তবাক্যের মতো এগুলি মেনে চলেন কৃষকরা। আধুনিক ও প্রাসঙ্গিক থাকার আরেকটি কারণ, খনার বচন বিস্ময়করভাবে ধর্মপ্রসঙ্গবর্জিত। কেন ধর্মের প্রসঙ্গ নেই? একটা সময়ের হিসেব দেওয়া যাক। কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, ৮০০-১১০০ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে খনার জন্ম, কারওর মতে আবার বরাহের সময়কালের (৫০০-) আশেপাশে অর্থাৎ ষষ্ঠ শতাব্দীতেই খনার জন্ম। তবে যে সময়েই জন্ম হোক, খনার বচনে ধর্মের প্রভাব না থাকায় তাঁর বঙ্গযোগের তত্ত্ব আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ আর্যদের মতো গোষ্ঠী ও পরবর্তীকালের বহু সম্রাট ব্যর্থ হয়েছেন বাংলা দখলে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষও বাংলায় বহু পরে বসতি গড়েছে। তাই মনে করা হয়, খনার সময়কাল এমনই, যখন বাংলায় কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের প্রভাব ছিল না।খনার বচন আধুনিক ও প্রাসঙ্গিক হওয়ার আরেকটি বড় কারণ এগুলি নারী অবমাননাকর শব্দ বর্জিত। নারীদের অসম্মান বা অবমাননা বহু গ্রন্থেই রয়েছে। একাধিক পণ্ডিতের কথায়, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও নারীদের ছত্রে ছত্রে হেয়, অপদস্থ করার উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু খনার বচন সেই প্রেক্ষিতে ব্যতিক্রমী।
জিভ কেটে নেওয়া হয় আজও
তখনকার দিনের মতো খনারা আজও শাস্তি পায়। তাদের পাণ্ডিত্য ও জ্ঞান সমাদৃত হলে বলি হতে হয় পুরুষদের ঈর্ষার। এই সেদিনও যখন একদিকে বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার প্রচলন করছেন, অন্যদিকে রক্ষণশীলেরা প্রচার করছেন লোকপ্রবাদ — ‘লেখাপড়া শিখলে মেয়ের স্বামী মরে।’ ইদানীংকালে এমন কথা ততটা শোনা না গেলেও ঠারে ঠারে নানাভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, নারীদের অতিরিক্ত পাণ্ডিত্য কোনওভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। পড়াশোনা শিখলেও তাই বিয়ের পর চাকরি করার অনুমতি পান না অনেক মেয়ে। বিয়ের চাপে জলাঞ্জলি দিতে হয় পড়াশোনা, কেরিয়ার। আবার বিয়ে না করতে চাইলে শিকার হতে হয় কটাক্ষ, কুমন্তব্য ও একটা সময়ের পর কুপ্রস্তাবের। ‘গ্র্যাজুয়েশন পাশ করলে পাত্র দেখব’ থেকে ‘এত পড়ে কাকে উদ্ধার করবি’, ‘মেয়েমানুষের বুদ্ধি’ থেকে ‘বাড়ির বাইরে এতক্ষণ কী করছিলি/করো’ — এখনকার দিনেও অনেকের কাছে খুব পরিচিত লব্জ। তবু মেয়েরা ‘গ্র্যাজুয়েশন পাশ’ দিয়ে মাস্টার্স ছাড়িয়ে রিসার্চ করেন। উদ্ধার করেন দেশ, সভ্যতা ও প্রাচীনতন্ত্রের গর্তে পড়ে থাকা মনগুলোকে। জিভ হারালেও ‘মেয়েমানুষি’ বুদ্ধি নিয়েই সুকৌশলে ছাপ রেখে যান নিজস্ব বচন, জ্ঞান ও বুদ্ধির। ছাপ রেখে যায় মানুষের স্বার্থে, সভ্যতার স্বার্থেই।
তথ্যঋণ
১. কিংবদন্তি খনা ও খনার বচন - পূরবী বসু
২. বৃহৎ খনার বচন - সুরেশ চৌধুরী
৩. খনার বচন - বঙ্গদর্শন