পাঠকের প্রতি: এই বিশেষ প্রতিবেদনটি এক বিশেষরকম আত্মহত্যা ও তার প্রতিরোধ নিয়ে লিখিত। HT বাংলার পক্ষ থেকে অনুরোধ, কোনও কারণে এটি পড়াকালীন বিচলিতবোধ করলে বা মানসিক অস্থিরতা হলে নির্দ্বিধায় তখনই পড়া বন্ধ করে পেজ থেকে বেরিয়ে যান। পাঠকদের সুবিধার্থে প্রতিবেদনের একদম শুরুতেই রইল আত্মহত্যা প্রতিরোধী হেল্পলাইন নম্বর।
আত্মহত্যা প্রতিরোধী হেল্পলাইন নম্বর — ওয়ানলাইফ ফাউন্ডেশন: 7893078930, লাইফলাইন ফাউন্ডেশন: 9088030303
১৯ ফেব্রুয়ারি: ভোররাতে অভিষিক্তা মোড়ের কাছে একটি গাড়ি এসে ধাক্কা খেল পিলারে। ভিতরে দুজন পুরুষ ও একজন নাবালক। তাদের উদ্ধার করার পর আহত একজন জানালেন তাদের ট্যাংরার বাড়িতে ৩ মহিলা আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে দেখে সত্যিই তাই। ওই ব্যক্তিদের দাবি, পরিবারের সকলে মিলে দেনার দায়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
২৮ ফেব্রুয়ারি: সংসারে চরম আর্থিক অসচ্ছলতা। মা-মেয়ের মৃতদেহের সঙ্গে সুইসাইড নোট উদ্ধার। ঘটনা মধ্যমগ্রামের দোহাড়িয়া এলাকার। পুলিশের অনুমান, মেয়েকে খুন করে নিজে বিষ খান মা।
১ মার্চ: বেহালার পর্ণশ্রী থানা এলাকায় শকুন্তলা পার্কে উদ্ধার করা হল বাবা-মেয়ের ঝুলন্ত দেহ। মেয়েটি অটিজমে আক্রান্ত বলে বাবা দুশ্চিন্তায় ভুগতেন বলে খবর। ছিল ফিল্টারের ব্যবসা। বাইরে থেকে হাসিখুশি ব্যক্তি এমন করতে পারেন, তা অনেকেই মানতে পারছেন না।
শহরের তিন প্রান্তের তিন ঘটনাকে জুড়ে দিয়েছে একটাই সূত্র - আত্মহত্যা। একা নয়, পরিবারের সকলে মিলে। তবে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে কি এই আত্মহত্যাগুলি কোনওভাবে প্রভাবিত? চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয়ে থাকে কপিক্যাট সুইসাইড? কপিক্যাট সুইসাইড নিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার সঙ্গে কথা বললেন মনোবিদ (সাইকোলজিস্ট) প্রথমা চৌধুরী ও ফর্টিস হাসপাতালের মনোরোগবিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রিস্ট) চিকিৎসক সঞ্জয় গর্গ।
কপিক্যাট সুইসাইড আদতে কী?
একজনের মনে আগে থেকেই থাকা আত্মহত্যাসংক্রান্ত চিন্তা রয়েছে। এবার সংবাদমাধ্যম বা খবরের কাগজে অন্য আরেকটি ঘটনা দেখার পর সে ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলছে, ঘটিয়ে ফেলার মতো পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাস পাচ্ছে। আত্মহত্যার দুটো পর্যায় হয় বলে জানাচ্ছেন মনোবিদ প্রথমা চৌধুরী। তাঁর কথায়, ‘একটি ধাপ হল আইডিয়েশন অর্থাৎ বিষয়টির কল্পনা আর আরেকটি দিক হল অ্যাকশন। দেখা যায়, আত্মহত্যা সংক্রান্ত ধারণা থাকলেও পরিবার বা স্বজনের কথা ভেবে পিছিয়ে আসেন অনেকে। মনের ভিতর একটা বাধা কাজ করে। কিন্তু যখন তিনি সংবাদমাধ্যম বা খবরের কাগজে দেখছেন — এমনটা করা যায়, তখন আর সেই বাধাটা থাকছে না। বাধাটা কাটিয়ে উঠছেন। কপিক্যাট সুইসাইডের এটাই বেসিক সাইকোলজি।’
অনেকেই মানসিকভাবে ভীষণ দুর্বল
মনোরোগবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সঞ্জয় গর্গ জানাচ্ছেন, ‘অনেকেই মানসিকভাবে ভীষণ দুর্বলতার মধ্যে থাকেন, অবসাদে ভোগেন। কিন্তু সেই কথা কাউকে জানাতে পারেন না। প্রাথমিক অবস্থায় আত্মহত্যার পদ্ধতি নিয়ে তাদের মধ্যে সন্দেহ থাকে। কিন্তু বিভিন্ন মিডিয়ায় আত্মহত্যাসংক্রান্ত খবর দেখলে তাদের এই সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা আরও স্পষ্ট হয়। তাঁর মধ্যে বিশ্বাস জন্মায়— আমিও পারব। তখন ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলে।’ আবার অনেকে আছেন, যাদের মধ্যে অ্যাটেনশন সিকিং বিহেভিয়ার কাজ করে। সঞ্জয় গর্গের কথায়, ‘যারা সেভাবে কারও থেকে মনোযোগ পান না, যারা চান যে তাদেরও অ্যাটেনশন দেওয়া হোক, অন্তত মিডিয়া আলোচনার কেন্দ্রে আনুক, তারাও ঘটিয়ে ফেলতে পারেন এমন ঘটনা।’

কপিক্যাট সুইসাইড প্রতিরোধের উপায়
সাহায্য চাওয়ার মানসিকতা -মানসিক সমস্যায় অনেকেই বর্তমানে ভুগছেন। কিন্তু সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হলে মনোবিদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। এই দিকটি নিয়ে আরও সচেতনতা প্রচার করতে হবে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসক সঞ্জয় গর্গ। তাঁর কথায়, ‘মানসিক স্বাস্থ্য এখনও আমাদের কাছে অবহেলার বস্তু হয়ে রয়েছে। যার ফলে মানুষের মধ্যে সাহায্য চাওয়ার মানসিকতা পর্যাপ্ত তৈরি হচ্ছে না। সচেতনতা প্রচারের মাধ্যমে এই বিষয়টিতে বদল আনা জরুরি।’
সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব যেখানে - সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব এখানে অনেকটাই বলে জানালেন প্রথমা। তাঁর কথায়, ‘প্রতিবেদন বা সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল হতে হবে। ভিক্টিমের (অর্থাৎ যিনি ঘটনার শিকার) নাম জানলেও কতটা তথ্য পাঠকের কাছে পরিবেশন করা যায়, সেই বিষয়ে একটি নীতি বজায় রাখা উচিত। পাশাপাশি আত্মহত্যার খবর করছি বলেই কীভাবে, কী উপায়ে একজন আত্মহত্যা করেছেন, সেই বিবরণ প্রতিবেদনে দেওয়া ঠিক নয়।’
কারওর মধ্যে বদল লক্ষ্য করা - কারওর রোজকার অভ্যাস, কথাবার্তায় বদল আসছে কি না সেদিকে নজর রাখাও আশেপাশের বা পরিচিত মানুষদের দায়িত্ব বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসক সঞ্জয় গর্গ। তাঁর মতে, ‘একটা মানুষ হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করত, আড্ডা দিত। হঠাৎ করে সে মেলামেশা বন্ধ করে দিল, আড্ডা দেওয়া বন্ধ করে দিল। কথা ঠিকমতো বলে না। খাবার ঠিকমতো খায় না। ফোন ধরে না। এরকম বদল দেখলে তাঁর কাছে গিয়ে বসা, তাঁর সঙ্গে কথা বলা খুব জরুরি। এটুকু করলে অনেক অনভিপ্রেত ঘটনা রুখে দেওয়া যায়।’
সুইসাইডাল আইডিয়েশন ধরতে পারা - কারওর মধ্যে আত্মহত্যার মানসিকতা দেখা গেলে সেই বিষয়ে সচেতন হওয়ার অনুরোধও জানাচ্ছেন প্রথমা। তাঁর কথায়, ‘অনেককেই বলতে শোনা যায়, ধুর আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। আশেপাশের যারা শুনছেন, তাঁরা ভাবেন এ হয়তো কথার কথা। মনোযোগ আকর্ষণ করতে এই ধরনের কথা বলছেন ব্যক্তিটি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এর মধ্যে সুইসাইড করার আইডিয়েশন লুকিয়ে থাকে। কেউ এই কথা বললে বুঝতে হবে সে আসলে সাহায্য চাইছে। মানসিকভাবে সে হয়তো সত্যিই ভালো নেই। তাই এই ধরনের কথা শুনলে এড়িয়ে না গিয়ে পাশে দাঁড়ানো উচিত। তাহলে এমন দুর্ঘটনা অনেকটাই এড়ানো সম্ভব।’

আত্মহত্যা প্রতিরোধী হেল্পলাইন নম্বর —
ওয়ানলাইফ ফাউন্ডেশন: 7893078930
লাইফলাইন ফাউন্ডেশন: 9088030303
পাঠকদের প্রতি: প্রতিবেদনটি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মতামতের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে। এটি সমস্যাটি সম্পর্কে সাধারণ ধারণার উপর আলোকপাত করা মাত্র। ব্যক্তিবিশেষে প্রতিটি সমস্যার চিকিৎসা এবং নিরাময়ের পদ্ধতি পৃথক। তাই যে কোনও সমস্যায় শুধুমাত্র এই প্রতিবেদনের কথায় ভরসা না রেখে, ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসকের বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।