
Betvisa
6.88% Weekly Cashback on 2025 IPL Sports
সে অনেক দিন আগের কথা। মনে থাকার কথা নয়, কিন্তু ঘটনা বৈচিত্র্যে সেদিনের কথা ভুলতে পারিনি। মনের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে, যেন গতকালের ঘটনা।
পয়লা জানুয়ারি ১৯৫৫ সাল। না, তখনও এই দিনটি বাঙালির ঘরে ঘরে কল্পতরু দিবস বলে প্রচার পায়নি। যাঁরা রামকৃষ্ণদেবের অনুরাগী ও স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত, শুধু তাঁরাই জানতেন এই দিনটির তাৎপর্য।
আমি তখন কলেজের ছাত্র। বয়স ১৮ বৎসর। বাবা কলকাতা পুলিশের বড় অফিসার। পার্ক সার্কাসে মস্ত একটি ভাড়া করা বাগানবাড়িতে থাকতাম। ঘটনাচক্রে সিমলার ৩ নম্বর গৌর মোহন মুখার্জি স্ট্রিটের সেই ভগ্নপ্রায় ‘ভুবনেশ্বরী বাসভবন’-এ যাতায়াত ছিল। বিশেষ করে পূজনীয় পুণ্যদর্শন মহেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে সপ্তাহে অন্তত দু’-তিন দিন যেতাম, তাঁর ভালবাসার টানে। তখন তাঁর বয়স ৮৫ বছর।
যাই হোক, সেই ১৯৫৫ সালের পয়লা জানুয়ারি আমি একটু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে স্নান করে নিলাম। তারপর সামান্য চা-জলখাবার খেয়ে দৌড় লাগালাম। সকাল সকাল পুণ্যদর্শন মহিমবাবুর চরণে প্রণাম করে আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য। মা মনে করিয়ে দিলেন,পথে যেন কিছু ফুল-ফল কিনে নিয়ে যাই কর্তাবাবুর জন্য।
ট্রাম লাইনে পৌঁছে ৮বি বাস একটু দাঁড়াতেই পেয়ে গেলাম। সেই বাস ধরে চলে গেলাম বিবেকানন্দ রোড-কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের মোড়ে। বাস থেকে নেমে চাচার হোটেলের পাশের গলি গৌর মোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ঢুকে পড়লাম।
স্বামীজির বাড়ির সদর দরজা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল কি না মনে নেই। তবে বাড়ির পশ্চিমদিকের ছোট দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। সেই দরজা দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে ছোট ঘরটিতে মহিমবাবু শুয়ে থাকতেন। ছোট দরজার সামনে সামান্য একটু ফাকা জায়গা ছিল, সেখানে দেখলাম অনেক পরিচিত মহিমবাবুর ভক্তরা পাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতে শালপাতায় কিছু ফলমূল ও সন্দেশ নিয়ে খেতে খেতে গল্প করছেন। পাশ কাটিয়ে ছোট দরজা দিয়ে ঢুকে দেখি ভিতরে বেজায় ভিড় মহিমবাবুকে প্রণাম করার জন্য। কোনও মতে হাতে ফুল নিয়ে তাঁর হাতে দিয়ে বললাম— প্রচুর ভিড় হয়ে গিয়েছে। তিনি সেদিন বিছানায় বসে ছিলেন থাবড়ি মেরে। পরনে ফর্সা একটি হাফহাতা জামা ও শীতবস্ত্র, কপালে একটি চন্দনের ফোঁটা কোনও মহিলার দেওয়া। তাঁর চরণে মাথা ঠেকিয়ে পাশের দেওয়ালে টাঙানো কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ঠাকুরের ও স্বামীজির ছবি প্রণাম করলাম,ফুলে ফুলে প্রায় ঢাকা যেন হাসছেন। নীচে যে মিটসেফ,তার মাথায় আর ফুল রাখার স্থান নেই। পূজনীয় মহিমবাবু আমার ও আমার মায়ের কুশল সংবাদ নিলেন, তারপর পাঠিয়ে দিলেন পাশের ছোট ঘরে, যেখানে হাতে হাতে শালপাতায় প্রসাদ বিতরণ হচ্ছিল। সবাই হাসি মুখ। সেই ছোট ঘরে স্থির হয়ে দাঁড়ানো যায় না,এত ভিড়। তাই আমিও অন্যান্যদের মত হাতে শালপাতা নিয়ে দরজার বাইরে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রসাদ খেতে লাগলাম। আমার পাশে দাঁড়িয়ে প্রসাদ খাচ্ছিলেন শ্রীবঙ্কিম লোধ মহাশয়। আমার চাইতে ৬-৭ বৎসর বয়সে বড়।
বঙ্কিমবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন কোথায় যাবেন?’ আমি বললাম, ‘কোথায় আর, বাড়িতেই ফিরব।’ উনি জিজ্ঞাসা করলেন, ফেরার তাড়া আছে? আমি উত্তর দিলাম, না,ফেরার কোনও তাড়া নেই। তখন বঙ্কিমবাবু বললেন, ‘চলুন, এক জায়গায় নিয়ে যাই আপনাকে।’ আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লাম গলি থেকে ট্রাম লাইনে। সেখান থেকে একটি ট্রাম ধরে চলে গেলাম শ্যামবাজারে। এবার ট্রাম ছেড়ে আমরা শ্যামবাজারের মোড় থেকে একটি উত্তরমুখী বাস ধরলাম গল্প করতে করতে। বাস চলল উত্তরদিকে,টালা ব্রিজের উপর দিয়ে,তারপর চিড়িয়ামোড় ছাড়িয়ে বিটি রোড ধরে। একটা চৌরাস্তার মোড় থেকে বাস বাঁদিকে ঘুরে পশ্চিমমুখী একটি অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তা ধরে গঙ্গার দিকে চলল। তারপর, ডাইনে ঘুরে থেমে গেল,বাস আর যাবে না। এটা নাকি বরানগর বাজার।
আমরা একটা সাইকেল রিকশা নিলাম, উলটোমুখে চলতে লাগলাম। সেই ১৯৫৫ সালে রাস্তায় এত ভিড় ছিল না। চারদিকে গরিব এলাকা দিয়ে এগিয়ে গেলাম। একটু পরে বাঁদিকে একটা উঁচু ও খুব লম্বা গোলাপি রং করা পাঁচিলের পাশ দিয়ে এগিয়ে চললাম। পাঁচিল যেখানে শেষ হল,তারপর একটি প্রকাণ্ড গেট। ফুল দিয়ে সাজানো। উপরদিকে ছোট একটি বোর্ডে লেখা রামকৃষ্ণ মঠ, কাশীপুর। দু’পাশে মাটির কলসির উপর যথারীতি আম্রপল্লব,ছোট কলাগাছ,আরও ফুল। অল্প চার-পাঁচ জন লোক গেটের কাছে ছিলেন,আর কিছু লোক গেটের ভিতরে ঢুকছিলেন ও বেরোচ্ছিলেন আধ-ভেজানো গেটের ভিতর থেকে।
আমি বঙ্কিমবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম— এটাই কি কাশীপুর উদ্যানবাটি?পরমহংসদেবের শেষ ঠিকানা? উনি উত্তর দিলেন— ‘হ্যাঁ,ঠাকুরের কল্পতরুর ঘটনা এখানেই ঘটেছিল। এই বাড়িতেই তাঁর মহাসমাধি হয়। তারপর,ঠাকুরের ভক্তদের এই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। ৭০ বছর পরে এই বাগানবাড়ি আবার রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে এসেছে। এটা খুব ভালোভাবে সংস্কার করে আজ জনসাধারণের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। চলুন ভিতরে যাই। বেলা একটা বেজে গিয়েছে।’
ভিতরে ঢুকে দেখি, বিশাল বাগান। চওড়া লাল সুরকি ঢালা রাস্তা গেট থেকে এগিয়ে গিয়েছে।তারপর দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। একটা পায়ে চলা রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে,আর একটি ধীরে ধীরে বামদিকে মোড় নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে একটি গোলাপি রঙের দোতলা বাড়ির দিকে,লোকজন সব সেদিকেই ভিড় করেছেন। সুরকি রাস্তার বাঁদিকে বাঁশ ও কঞ্চি দিয়ে নিচু বেড়া দেওয়া। একটু এগিয়ে দেখলাম বাঁদিকে জল দেখা যাচ্ছে, ঘাটও আছে, সেটি একটি পুকুর। সেই ঘাটের বিপরীতেই সেই গোলাপি রঙের দোতলা বাড়ি। বাড়িটির বাইরে জুতো খুলে ভিতরে ঢুকতে হয়,সেখানে একটি হলঘর। যতদূর মনে পড়ে,পাথরের মেঝে,বাঁদিকে একটি বেশ পাকাপোক্ত কাঠের সিঁড়ি উঠে গিয়েছে দোতলায়।
ওদিকে গেটের সুরকির রাস্তার ডানদিকে প্রকাণ্ড বড় মাঠ,বড় বড় গাছ আছে কয়েকটি। সেখানে বাঁশ বেঁধে বেঁধে ভিড় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হয়েছে। ঠিক মোড়ের পাশে সেই বিখ্যাত হেলে যাওয়া গাছটি দেখেছি কি না মনে নেই। মাঠের মধ্যে এখানে সেখানে ত্রিপল বা শামিয়ানা টানিয়ে তাঁবু পড়েছে, তার নীচে শতরঞ্চি বা মাদুর পেতে লোকজন কোথাও ‘কথামৃত-পাঠ’শুনছেন,কোথাও শাস্ত্রপাঠ শুনছেন,কোথাও খোল-করতাল বাজিয়ে মহানন্দে কীর্তন করছেন। চারদিকে লাল-হলুদ গাঁদা ফুলের সমারোহ, উৎসবের পরিবেশ। আর উল্লাসের কেন্দ্রবিন্দু হল সেই গোলাপি বাড়ি,পুরনো আমলের কাঠের খড়খড়ি দেওয়া জানলার পাল্লা,মাথায় কাঠের সুন্দর ডিজাইনের ঢাকা দু-পাশ ধরে কিছুটা নেমে এসেছে। জানলার পাল্লার ও মাথার ঢাকার রং কিন্তু সবুজ,ভারি চমৎকার।
বাড়ির ভিতরে হলঘরের এপাশ ওপাশে আরও কয়েকটি মাঝারি সাইজের ঘর রয়েছে,সামনের ঘরের মাথায় সাদা-কালো বোর্ডে লেখা রয়েছে দানাদের ঘর। দক্ষিণের ঘরে একটি মস্তবড় টেবিলের উপর এই বাড়িটির একটি মডেল রাখা রয়েছে,যাতে সবাই ঠিক বুঝতে পারেন কোথায় কি আছে।
উৎসবের কেন্দ্র কিন্তু হল ওই দোতলার হলঘরে ফুলে সুসজ্জিত নীচু একটি খাট,যাতে পরমহংসদেবের একটি ছবি শোভা পাচ্ছে। যে ঘরে তিনি প্রায় নয় মাস রোগশয্যায় শুয়ে নরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে রামকৃষ্ণ সংঘের সূত্রপাত করে গিয়েছেন।
আমরা দু’জন লাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে উঠলাম সেই কাঠের সিঁড়িটির উপরে,যে সিঁড়িতে ভরা দুধের বাটি নিয়ে মা সারদা একদিন পড়ে গিয়েছিলেন। ওপরে উঠে সেই নিচু খাটের সামনে নীস্তব্ধ হয়ে প্রণাম জানালাম, তারপর ওই একই পথে নীচে নেমে এলাম। এখানে সাধু-ব্রক্ষ্মচারীদের সতর্ক দৃষ্টি দর্শকদের উপরে। নিচের একটি ঘর থেকে প্রসাদ বিতরণ হচ্ছে বটে কিন্তু সেখানে ভিড়ের ঠেলায় স্থির করলাম,প্রসাদের জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। নিজেদের চটি-জুতো ফেরৎ পেয়ে দু’জনে আবার বাইরে হাঁটা লাগালাম গেটের দিকে, গল্প করতে করতে।
সেই ১৮৮৬ সালের পর ৭০টি বৎসর কেটে গেল, এতদিন কী হচ্ছিল এখানে?এই শ্রীরামকৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি,এত দিন রামকৃষ্ণ মিশনের দখলে আসতে লাগলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর বঙ্কিমবাবু আমাকে দিতে পারেননি সেদিন। আমার ওই ১৮ বৎসর বয়সে কিছু জানা সম্ভব ছিল না। আরও ৩০ বৎসর লেগেছিল আমার সেই পটভূমিকার ইতিহাস জানতে,সেই নাট্যের মধ্যে ইহুদি মার্টিন সাহেবের,অথবা আচার্য শ্রীসত্যানন্দ দেবের ভূমিকা কী ছিল, তা জানতে।
যখন দু’জনে বাগানবাড়ির প্রায় গেটের কাছে এসে গিয়েছি, তখন গেট দিয়ে ধীরে ধীরে একটি স্টিল রঙের অস্টিন গাড়ি ঢুকল,তারপর ডানদিক ঘুরে পাঁচিলের দিকে মুখ করে থেমে গেল। গাড়ির মালিক ড্রাইভারের সিট থেকে নেমে পিছনের সিটের দরজা খুলে দিলেন। একজন বৃদ্ধ গেরুয়াপরিহিত সাধু নামলেন। বঙ্কিমবাবুর কথা হঠাৎ থেমে গেল,তিনি গাড়ির দিকে দৌড় লাগালেন,আমিও কিছু না বুঝে তাঁর পিছনে ছুটলাম। বঙ্কিমবাবু শুধু বললেন, ‘আরে,এ যে কাশীর ভক্তরাজ মহারাজ।’বলেই সাধুকে প্রণাম করে হাসিমুখে বললেন, ‘আমরা মহিমবাবুর কাছে যাতায়াত করি তো, আপনাকে জানি।’ আমিও সেই সুবর্ণসুযোগে সাধুকে প্রণাম করলাম। মহিমবাবুর লেখা ‘কাশীতে স্বামী বিবেকানন্দ’ পড়েছি, সেই বিবরণ তো সবটাই এই ভক্তরাজ মহারাজের স্বামীজির সঙ্গী থাকার বিবরণ। মাথায় হাত দিয়ে আমাদের আশীর্বাদ করলেন তিনি, আর মহিমবাবু ও ধীরেনবাবুর কুশল সংবাদ নিয়ে পরম খুশি হলেন। বঙ্কিমবাবু সেই গাড়ির মালিককে বললেন, ‘পোদ্দারবাবু (নাকি সেনবাবু), আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না,আমরাই ওঁকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছি।’ ভদ্রলোক হেসে সরে দাঁড়ালেন, আর আমরা দু’জন অতি পরিচিত আপনজনের মতো ভক্তরাজ মহারাজের দু’পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর দু’বাহু কাঁধে তুলে নিলাম। ভাবলাম,এই সুযোগে কিছু কথাবার্তা বলা যাবে। কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলাম না।
মাত্র পাঁচ-ছয় পা এগিয়েছি, এপাশ ওপাশ থেকে লোকজন জিজ্ঞাসা শুরু করল ‘ইনি কে?ও ভাই,এই মহারাজের নাম কি?একটু বলবেন ইনি কে?’ বুক ফুলিয়ে বঙ্কিমবাবু উত্তর দিলেন, ‘ইনি কাশী সেবাশ্রমের স্বামী সদাশিবানন্দ,স্বামী বিবেকানান্দের শিষ্য।’ আর যায় কোথায়! দেখতে দেখতে আমদের অগ্রগতি সম্পূর্ণ রুদ্ধ হল সুরকির রাস্তার সেই বাঁকের মুখে। শুনেই লোকজনের চোখের যা অবস্থা, দেখে পুলকিত হচ্ছিলাম। কিন্তু পুলক ক্ষণস্থায়ী। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল এই সংবাদ সেই জনসমুদ্রে। ঝুপ করে প্রণাম করেই দৌড়োচ্ছেন লোকজন নিজের দলকে বলবার জন্য, এ ওঁকে বলছেন,ও এঁকে বলছেন। ভদ্রমহিলারা ঝপ ঝপ প্রণাম করছেন। মহা মুশকিলে পড়লাম।
এই হুড়োহুড়ি দেখে কাছাকাছি যে সব মঠের সাধু ব্রক্ষ্মচারী ছিলেন,তাঁরা দৌড়ে এলেন ব্যাপারটা কী,জানবার জন্য। তাদের আর বলে দিতে হল না বৃদ্ধ সাধুর পরিচয়। তবু সন্দেহ নিরসনের জন্য তাঁরা আমার থেকে নীচু গলায় জেনে নিলেন ইনি ভক্তরাজ মহারাজ কি না। তারপর তাঁরাও শিশু হয়ে গেলেন। ঢিপ করে প্রণাম করে ব্রক্ষ্মচারী তাঁর সাদা উত্তরীয় উড়িয়ে সঙ্গীদের ডেকে নিলেন মহা আনন্দে,আর একটা বৃত্ত তৈরি করে ফেললেন শুধু আমাদের ঘিরে। এবার তাঁদের ওই বেষ্টনী জনসাধারণকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল সেই গোলাপি বাড়ির দিকে। আমরা ওই বেষ্টনীর মধ্যে ভক্তরাজ মহারাজকে কাঁধে নিয়ে নিরাপদে চলতে লাগলাম।
এবার এসে পড়লাম বাড়ির দরজায়। সেখানে বয়স্ক সাধুরা জোড়হাতে প্রতীক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। এবার এগিয়ে এলেন ওই মঠের মোহন্ত বিনয় মহারাজ, বৃদ্ধ সাধুকে তাঁরা সকলে প্রণাম করলেন, আর বলা নিষ্প্রয়োজন, চারদিকে জনতার থিকথিকে ভিড়।
ধীরে ধীরে আমাদের কাঁধে ভর দিয়ে ভক্তরাজ মহারাজ সিঁড়ি দিয়ে উঠলেন দোতলায়,পিছনে গেরুয়া আর সাদা উত্তরীয়ের ভিড়। শ্রীশ্রীঠাকুরের ঘরের সামনে এসে পড়লাম। ঠাকুরের খাটের সামনে দড়ি দিয়ে ঘেরা ছিল,সেটা তুলে নেওয়া হল যাতে আমরা একেবারে খাটের সামনে ওঁকে হাজির করতে পারি। তাই হল। উনি তখন মৃদু স্বরে বললেন, ‘আমি এখানে একটু বসব।’ সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমাদের বন্ধনমুক্ত হয়ে তিনি ওই বৃদ্ধ শরীরেও সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন শয্যার সামনে,তারপর ধ্যানে বসলেন। সিঁড়ির লোকজন ওঠা আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল,এবার আমরাও একটু পিছিয়ে এলাম।
একটু পরে প্রশান্ত দীপ্তমুখে ভক্তরাজ মহারাজ আবার প্রণাম করে উঠলেন।আমরা দু’জনে এগিয়ে গিয়ে আবার তাঁর দু’বাহু তুলে নিলাম কাঁধে। আমাদের উপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নামলেন মহারাজ। নীচে বিরাট ভিড়,সবাই প্রণাম করতে চান। সে পর্ব শেষ হতে এবার সাধু ব্রক্ষ্মচারীরা আমাদের অনুরোধ করলেন যে তাঁরা একটু আলাদা করে ভক্তরাজ মহারাজকে প্রসাদ খাওয়াতে নিয়ে যেতে চান,তাই এবার তাঁকে একটু আমরা যেন ছেড়ে দিই। এবার ভক্তরাজ মহারাজের পিছনে পিছনে আমরা গেলাম এবং প্রসাদ পেলাম। যত সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারী ছিলেন ওই বাগানবাড়িতে,তাঁরা সবাই উপস্থিত। কি খুশির হিল্লোল। এবার তাঁর ফেরার পালা। গাড়ি পর্যন্ত সবাই চললাম ধীরে ধীরে। গাড়ির কাছেই সেই ভদ্রলোক ছিলেন, ভক্তরাজ মহারাজকে বসানো হল পিছনের সিটে। আমি বসলাম সামনের সিটে এবং বঙ্কিমবাবু বসলেন পিছনে মহারাজের পাশে।
এতক্ষণ যাঁর ভার বহন করেছি,এবার আমাদের আবদার তাঁকে তো শুনতে হবেই। এই সুযোগ পেয়েছি,সুতরাং তাঁকে আমাদের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে নিয়ে যাবই, সকলে তাঁর পাদস্পর্শে ধন্য হবে। তিনি কিছুতেই রাজি হন না,আমিও নাছোড়বান্দা। যাঁর গাড়ি,সেই ভদ্রলোক হাসিমুখে সবই শুনছেন,কোনও মতামত দিচ্ছেন না। শেষে মাত্র ৫ মিনিটের যাত্রাবিরতির কথায় সকলকে রাজি করানো গেল। সে এক স্মরণীয় দিন।
আমাদের বিশাল বাগান বাড়িতে ঢুকে সবাই খুশি। আমি দৌড়ে গিয়ে উপরে মাকে খবর দিলাম। অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্য। ভক্তরাজ মহারাজ গাড়ি থেকে নামলেন,নিজে চেয়ে শুধুমাত্র একটু জলপান করলেন,আর করলেন অজস্র আশীর্বাদ। মায়ের অভিযোগ,আমি পূজো-আচ্ছার দিকে মাড়াই না,শুধু মহিমবাবুর কাছে যাই। শুনে হেসে তিনি আমাকে কাছে টেনে নিলেন। বাঁ হাতে আমার মাথাটাকে ধরে ডান হাতের বুড়ো আঙুল আমার কপালে চেপে ধরে একটু জপ করলেন। ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘ওর কিছুই করতে হবে না। যখন মহিমবাবুর কাছে গিয়ে পড়েছে, আর তাঁর স্নেহ পেয়েছে,যা করাবার সব সময় মতো তিনিই করিয়ে নেবেন। বাবা! সোজা কথা,তাঁর মতো মহাপুরুষের স্নেহ পেয়েছে। রাজার বেটা,বড় হয়ে রাজাই হয়। কোনও চিন্তা নেই।’ সেই সময় সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা আবার পেলাম। যেন আমি ভেসে চলেছি আনন্দে এক ঘোরের মধ্যে। কোনও প্রশ্ন নেই,চাহিদা নেই,প্রার্থনা নেই,কোনও কিছু না পাওয়ার ক্ষোভ নেই।
সেই সুখস্মৃতি আজও ধরে আছি পরম যত্নে বুকের মধ্যে, যদি আবার একটু আস্বাদন পাই। বয়স যত বাড়ছে,এগুলি ততই ঘন ঘন মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে।
আমার গল্প শেষ হল। কাশীপুর বাগান বাড়িতে প্রথম কল্পতরু উৎসবের স্মৃতি কারও যদি ভাল লাগে, আমি ধন্য হব।
লেখক পরিচিতি: প্রশান্তকুমার রায়ের জন্ম ১৯৩৬ সালে। স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তের সান্নিধ্য পান ১৯৫৪ সাল থেকে। প্রশান্তবাবু পেশায় ছিলেন মেরিন রেডিয়ো অফিসার। সমুদ্রযাত্রায় বিশ্বের নানা দেশে গিয়েছেন, এমনকী উত্তর মেরুতেও। কিশোর বয়স থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ সাহিত্যের অনুরাগী। এই বিষয়ে বই লিখেছেন, করেছেন গবেষণা। অশীতিপর প্রশান্ত কুমার রায় এখনও জ্ঞানচর্চায় নিরলস।
6.88% Weekly Cashback on 2025 IPL Sports