এ বছর পুজো কাটান ভিন্ন স্বাদে। ঘুরে আসুন গ্রাম বাংলার অন্তরে।শহরের কোলাহল ব্যস্ততা থেকে পালিয়ে নিশ্বাস নিয়ে আসুন ক’টা দিন। শহর কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে পুরুলিয়া। এই জেলার কোলে লুকিয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটা অন্যরকম পুজো। যে পুজো আর পাঁচটা পুজোর থেকে একেবারেই আলাদা। আসুন জেনে নেওয়া যাক একেবারে ভিন্ন স্বাদের সেই পুজো গুলোর বিশেষত্ব-
পুরুলিয়ার মানবাজার থানার গড় পাথর মহড়া রাজবাড়ির পুজো – এই পুজো প্রায় আড়াইশো বছর প্রাচীন পুজো। অন্যান্য পুজোর মতো ষষ্ঠী থেকে আরাধনা হয় না মায়ের। এই বিশেষ পুজো শুরু হয় পিতৃপক্ষের নবমীর দিন থেকে। তারপরে পুজো চলে টানা ১৬ দিন।নবপত্রিকা রূপেই মায়ের পুজো করা হয়। রাজবাড়িতে তোপ দাগা হয় আজও। সেই আওয়াজ শুনের মন্দিরে ছাগ বলি হয়। মন্দিরের সামনে সারে সারে সাজানো থাকে রাজবাড়ির প্রাচিন অস্ত্রশস্ত্র।
আরও পড়ুন: এই পুজোতে গ্রাম বাংলায় পাড়ি দিন, জেনে নিন নির্জনে পুজো কাটানোর বিশেষ কিছু ঠিকানা
আগে বিজয়ার দিনে এ বাড়ির জমিদার প্রজাদের খোঁজ-খবর নিতে বেরোতেন। কার কতো ফসল হয়েছে। কে কী সমস্যা রয়েছে। এসব জানা হতো সেদিন। সকলের সমস্যা দূর করতে সভা বসতো। সেই রীতি মেনে আজও এই বাড়ির বংশধর রাজটুপি পরে হাতে গড়গড়া নিয়ে সভা বসান। নিমন্ত্রণ করে ডাকা হয় গ্রামের বিশিষ্ট জনদের।
মল্লরাজ বাড়ির পুজো- পুরুলিয়া থেকে খানিক দূরে অবস্থিত বাঁকুড়া জেলা। বাঁকুড়া জেলার একটি অতি পরিচিত পর্যটক কেন্দ্র হল বিষ্ণুপুর। বিষ্ণপুরেই রয়েছে মল্লরাজ রাজবাড়ি। এই বাড়ির পুজোর গল্পটাও বেশ অন্যরকম। এ বাড়ির প্রতিমা গঙ্গা মাটির তৈরি। পুজোর পরে কোনওদিন প্রতিমাকে বিসর্জন দেওয়া হয় না। স্বপ্নাদেশ এলে রং করা হয়। দুর্গোৎসবের প্রায় ১৫ দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় এই বাড়ির পুজো। ফৌজদার পরিবারের পটশিল্পীর ঘর থেকে আনা হয় পটে আঁকা দুর্গা যাকে বলা হয় ‘বড় ঠাকুরানি’। আসল মূর্তির ডান পাশে রাখা এই পট।
চতুর্থীর আনা হয় আরও একটি পট দুর্গা যাকে বলা হয় ‘মেজো ঠাকুরানি’। বড় ঠাকুরানির ডান দিকে বসানো হয় এই পট।আর পুজোর শুরুর দিন আসেন ‘ছোট ঠাকুরানি’ যাকে একেবারে দেবী মায়ের গা ঘেঁসে বসানো হয়। সব শেষে থাকে খচ্চর বাহিনী। আজও রাজবাড়ি সংলগ্ন মুর্চা পাহাড়ে কামান দেগে শুরু হয় সন্ধিপুজো।
মহানবমীর রাতে অত্যন্ত গোপনে খচ্চর বাহিনীর পুজো করা হয়। এই পুজোতে রাজ বাড়ির লোক ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারেন না। এই পুজো বহু প্রাচিন তাই এর রীতি নিয়মও একেবারেই আলাদা।
এই পুজোতে রয়েছে আরও এক বিশেষ চমক। একাদশী ও দ্বাদশীর দিন রাবণ বধ নৃত্য আয়োজিত হয় রাজ বাড়িতে। হনুমান, জাম্বুবান, বিভীষণ, সুগ্রীবের মুখোশ পরে শহর জুড়ে রাবণ কাটা নৃত্য পরিবেশন করেন লোক শিল্পীরা। সব শেষে রঘুনাথ মন্দিরের সামনে রাবণবধ এবং কাটা রাবণের মাটি ঘরে রাখার জন্য হুড়োহুড়িতে মাতেন এলাকার বাসিন্দারা।
বড়ু চন্ডীদাসের স্মৃতিধন্য ছাতনার রাজবাড়ির পুজো-
ছাতনার রাজবাড়ির সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জড়িত। এ বাড়ির কুল দেবতা হল দেবী বাসলী। সেই দেবীর পুরোহিত ছিলেন বড়ু চণ্ডীদাস। তিনিই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচনা করেছিলেন।
প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছরের প্রাচীন এই পুজো। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের দেবীর সঙ্গে এখানকার প্রতিমার অনেকটাই মিল রয়েছে। জিতাষ্টমীতে দেবীর বোধন হয়।
এ বাড়ির পুজোর আরও একটি বিশেষ নিয়ম হল, এখানে পুজোর শুরুতে পরিবারের প্রধানের নাম ও পুজোর সাল নতুন কাপড়ে লিখে দেবীর পায়ের কাছে রেখে দিতে হয়। সেই নিয়ম আজও চলে আসছে। পরে, ওই নাম লেখা কাপড় পূর্বপুরুষদের নাম লেখা কাপড়গুলির সঙ্গে এক জায়গায় বেঁধে রেখে দেওয়া হয়। নবমীর দিন পাঁঠা বলি হয় এই বাড়ির পুজোয়।
আরও পড়ুন: অবিকল যেন একটা মন্দির! নিউটাউনের এই প্যান্ডেল দেখলে চমকে যাবেন
এখানকার পুজোর অন্যতম দৃষ্টি আকর্ষণের কারণ হল ‘ডালা দৌড়’ ও ‘খাঁড়া দৌড়’। ছাতনা, দুবরাজপুর, কামারকুলি, ঘোড়ামুলি, হাতিশাল প্রভৃতি গ্রামের বাসিন্দারা ডালা ভর্তি নৈবেদ্য সাজিয়ে সন্ধিক্ষণের পুজোয় আসেন। দেবীর কাছে তাঁরা আগে নিজের নৈবেদ্য দেওয়ার জন্য দৌড়ান। যা ‘ডালা দৌড়’ নামে পরিচিত।
প্রতিমা বিসর্জনের সময় রাজপুরুষদের তরবারি, ছুরি, ঢাল ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এলাকার বাসিন্দারা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় যোগ দেন। বিসর্জনের পর সেই সব অস্ত্র হাতে নিয়ে কুলদেবী বাসলী মায়ের মন্দির পর্যন্ত দৌড়ে যেতে হবে। যা ‘খাঁড়া দৌড়’ নামে পরিচিত। এই বাড়ির ঐতিহ্যময় পুজো দেখতে আজও ভিড় জমান বহু মানুষ।