ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD) বর্তমানে একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে উঠেছে। যা বিশ্বব্যাপী লক্ষ-লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করছে। একে 'নীরব মহামারী' হিসেবেও চিহ্নিত করছেন চিকিৎসকরা। কারণ চিকিৎসকদের মতে, এটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। ফলে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা দেরিতে শুরু হয়। যখন শরীরে ফোলা, ক্লান্তি এবং প্রস্রাবে পরিবর্তনের মতো উপসর্গ দেখা যায়, তখন কিডনির ক্ষতি ইতিমধ্যেই গুরুতর হয়ে যায়, যা চিকিৎসাকে জটিল করে তোলে। আর সেই ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশন নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরলেন মণিপাল হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের পরামর্শদাতা ডাঃ জয়ন্ত দত্ত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, CKD বৃদ্ধির প্রধান কারণ হল ডায়াবেটিস এবং হাইপারটেনশন, যা কিডনি বিকলের (কিডনি ফেলিওর) প্রধান কারণ। ভারতে CKD তে আক্রান্তদের প্রায় ৬০% এই দুটি রোগের কারণে হয়। এত গুরুতর পরিস্থিতির পরেও মানুষ এই রোগ সম্পর্কে এখনও যথেষ্ট সচেতন নয়, যার ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্তকরণ ও প্রতিরোধ আরও কঠিন হয়ে পড়ছে।
ভারতে ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশনের ক্রমবর্ধমান বোঝা
বিশ্বের মধ্যে ভারতেই ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সর্বাধিক। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন (IDF) ২০২৩-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ভারতে ১০১ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং আরও ১৩৬ মিলিয়ন মানুষ প্রিডায়াবেটিক অবস্থায় রয়েছে। এই প্রবণতা চলতে থাকলে ২০৪৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১৩৫ মিলিয়নে পৌঁছাতে পারে।
অন্যদিকে, কিডনি রোগের আরেকটি প্রধান কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (ICMR)-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতের ৩২% প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক এটি সম্পর্কে সচেতনই নন। যারা সচেতন, তাদের মধ্যেও মাত্র ১২% সফলভাবে তাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশন কীভাবে কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে?
যখন রক্তে শর্করার পরিমাণ দীর্ঘ সময় ধরে বেশি থাকে, তখন কিডনির ছোট রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে টাইপ ১ ও টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি নামে একটি গুরুতর জটিলতা দেখা দিতে পারে। সময়ের সাথে সাথে, এই ক্ষতিগ্রস্ত রক্তনালী কিডনির পরিস্রাবণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে শরীরে পানি জমতে শুরু করে এবং ফোলা দেখা যায়।
অন্যদিকে, উচ্চ রক্তচাপ কিডনির ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা দাগ তৈরি করে এবং রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত করে। এর ফলে কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রেই কিডনি বিকল হয়ে যায়, যেখানে রোগীকে ডায়ালাইসিস বা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাতে হয়।
কেন CKD বাড়ছে?
বর্তমানে CKD আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। তবে, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এটির অন্যতম প্রধান কারণ।অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা, এবং শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা এই সমস্যাগুলোর ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিডনির স্বাভাবিক কার্যকারিতা কমতে থাকে, যা CKD-এর অন্যতম কারণ। অতিরিক্ত ব্যথানাশক ওষুধ সেবন বিশেষ করে নন-স্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস (NSAIDs) যেমন আইবুপ্রোফেন ও ডাইক্লোফেনাক দীর্ঘ সময় ধরে খেলে কিডনির ক্ষতি হতে পারে, বিশেষ করে ডায়াবেটিক এবং হাইপারটেনসিভ রোগীদের ক্ষেত্রে।
সচেতনতার অভাব ও দেরিতে রোগ নির্ণয়: নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার অভাবের কারণে অনেক মানুষ কিডনি রোগ সম্পর্কে অবগত হন না, যার ফলে চিকিৎসা তখনই শুরু হয়, যখন কিডনি ইতিমধ্যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্তকরণের গুরুত্ব
CKD প্রাথমিক পর্যায়ে কোনও লক্ষণ প্রকাশ করে না। তাই, নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত যাদের CKD-এর ঝুঁকি বেশি। ইউরিন অ্যালবুমিন-টু-ক্রিয়েটিনিন রেশিও (UACR) পরীক্ষা: এটি প্রস্রাবে প্রোটিন ক্ষতি শনাক্ত করতে সহায়ক। সিরাম ক্রিয়েটিনিন ও ইস্টিমেটেড গ্লোমেরুলার ফিস্ট্রেশন রেট (eGFR) পরীক্ষা: কিডনির কার্যকারিতা নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রক্ত পরীক্ষা। কিডনি আল্ট্রাসাউন্ড, কিডনির গঠনগত কোনো ত্রুটি শনাক্ত করতে সহায়তা করে ।
কারা নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করাবেন?
১) ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত ব্যক্তিরা
২) পরিবারের কারও কিডনি রোগের ইতিহাস থাকলে
৩) স্থূলতা বা দীর্ঘ সময় ধরে ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করলে
নতুন চিকিৎসা ও কিডনি রক্ষা করার উপায়
বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানে CKD প্রতিরোধ ও ধীরগতিতে বাড়তে বাধা দেওয়ার জন্য নতুন কিছু ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। SGLT2 ইনহিবিটরস (যেমন ডাপাগ্লিফ্লোজিন ও এমপাগ্লিফ্লোজিন): গবেষণায় দেখা গেছে, এগুলি CKD-এর অগ্রগতি ৪০% কমাতে সক্ষম। GLP-1 রিসেপ্টর অ্যাগোনিস্টস (যেমন সেমাগ্লুটাইড ও ডুলাগ্লুটাইড): ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কিডনি সুরক্ষাতেও কার্যকর। তবে এই ওষুধগুলো কেবল প্রাথমিক পর্যায়েই কার্যকর। দেরিতে ধরা পড়লে CKD একবার গুরুতর হলে তা আর প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় এবং রোগীকে ডায়ালাইসিস বা কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ওপর নির্ভর করতে হয়।
কিডনি সুস্থ রাখতে কী করবেন?
১) রক্তে শর্করার মাত্রা ১১০ mg /dL-এর নিচে ও রক্তচাপ ১৩০/৮০ mmHg-এর নিচে রাখা
২) কম লবণ ও কম প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ
৩) উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার কম খাওয়া
৪) প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট শারীরিক ব্যায়াম করা
৫) অতিরিক্ত ব্যথানাশক ওষুধ (NSAIDs) না খাওয়া
নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করানো
ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার মাধ্যমে CKD প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত হলে চিকিৎসা অনেক সহজ হয় এবং কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।