সার্ভাইব তো পোকামাকড়রাও করে, কিন্তু মানুষকেও যদি তা করতে হয় তবে বাঁচার সার্থকতা কোথায়? বাঁচার মতো বাঁচতে হবে, জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে উপভোগ করতে হবে। কাছের মানুষগুলোর পাশে থেকে জীবনটাকে বাঁচার মধ্য যে আছে আনন্দ আছে তা আর কোথাও নেই। তথাগত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত 'রাস'-এর প্রতিটা দৃশ্যে যেন সেই বার্তাই উঠে এসেছে। ছোটো হতে থাকা পরিবার আর ব্যস্ততায় ভরা জীবনের মাঝে 'রাস' যেন শীতলপাটি, যেখানে বসে খানিক বিশ্রাম নেওয়া যায়।কেমন হল ‘রাস'?মানুষের জীবনে এখন ব্যস্ততার শেষ নেই। ঘুম থেকে উঠে থেকে ঘুমতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত চলে প্রতিদিনের ইঁদুর দৌড় ফ্ল্যাটের ইএমআই, প্রোমোশন, বিদেশের টিপ, দামী গাড়ি এই সব নিয়ে। এই উপরে উঠতে থাকার দৌড়ে এক মুহূর্ত সময় নেই পাশে মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলার। সবটাই এখন মুঠো ফোন আর ল্যাপটপে বন্দি, আর মানুষগুলো ভাঙতে থাকা ছোটো ছোটো পরিবার নিয়ে বন্দি শহরের সব বাক্স বাড়িগুলোয়। সেখানে অর্থ, প্রতিপত্তি, নাম, যশ আছে। নেই কেবল খোলা মাঠ, আড্ডা, কাছের মানুষগুলোর ভালোবাসা, বেঁচে থাকার আনন্দ আর একটু জিরিয়ে নেওয়ার সময়। কিন্তু তাতে অবশ্য বেশির ভাগেরই বিশেষ মাথাব্যাথা নেই, এতেই তাঁদের আনন্দ। কিন্তু যাঁরা এতে আনন্দ পায় না। সব কিছুর মধ্যে থেকেও একজন বন্ধুকে খোঁজে। এই গল্প তাঁদের। এই গল্প সেই সব সোমনাথদের যারা প্রতিদিন নিজের ইচ্ছেকে বিসর্জন দিয়ে ৯টা ৫টার চাকরি করে।'রাস'-এর সোমনাথের জীবনটাও তাই। তার ছেলেবেলা কেটেছিল গ্রাম্য পরিবেশে যৌথপরিবারে সকলের ভালোবাসা পেয়ে। কিন্তু তার মায়ের মৃত্যুর পর তার পরিবারের সঙ্গে বাবার মনোমালিণ্য হওয়ার জন্য গ্রাম থেকে তার বাবা তাকে শহরে নিয়ে আসে। তারপর আর কী শহরের আর পাঁচটা মানুষ যে ভাবে ফ্ল্যাটে থেকে বড় হয়। তারপর দামী একটা চাকরি করে, বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখে, তেমন করেই চলতে থাকে সোমনাথের জীবন। তারপর বিদেশের যাওয়ার সুযোগও আসে, কিন্তু তার আগে তার হাতে আসে তার 'দিদা আম্মা'র চিঠি। আর সেই চিঠির হাত ধরেই পূর্বজন্মের স্মৃতির মতো তার ফেলে আসা ছেলেবেলা তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর আর কী সে গ্রামে যায়, ফের তার পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়। সেখানেও নানা ঘটনা ঘটতে থাকে, তবে এই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে গ্রামের সরলতা তাঁর মননে প্রবেশ করে। তারপর শেষ পর্যন্ত কী হয় তা জানতে গেলে দেখতে হবে 'রাস'।অভিনয় কেমন লাগল?'সোমনাথ'-এর ভূমিকায় বিক্রম চট্টোপাধ্যায় দুর্দান্ত। সারল্যে মাখা এই চরিত্রকে যথাযথ ভাবে তুলে ধরেছেন অভিনেতা। তাছাড়া রাইয়ের চরিত্রে দেবলীনা কুমারও বেশ মানানসই। এছাড়াও খুব অল্প সময়ের জন্য রণজয় বিষ্ণু পর্দায় দেখা গেলেও তাঁর অভিনয়, তাঁর চরিত্র দর্শকদের মন ছুঁয়ে যাবে। আর যাঁর কথা না বললেন নয়, তিনি হলেন অনুসূয়া মজুমদার। তাঁর অভিনয় আপনাকে কাঁদাবে, হাসাবে, ভাবাবে। তাছাড়াও ছবির অন্যান্য কলাকুশলীরা প্রত্যেকেই বেশ ভালো কাজ করেছেন।ওভারঅল কেমন লাগল?তথাগত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত এই ছবি জীবনের কথা বলে, সকলের সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকার জয়গান গায়। যৌথ পরিবারের মূল্যবোধের গল্প বলে। নিঃস্বার্থ ভালোবাসার গল্প বলে। শহরের দমবন্ধ করা, হাফিয়ে ওঠা জীবনের অক্সিজেন ভরা খোলা মাঠ হল 'রাস'। ছবির দৃশ্যায়ন বেশ সুন্দর। ছবিটা পর্দায় দেখতে এত ভালো লাগবে যে, মন জুড়ে একটা শান্তির ভাব কাজ করবে। তবে ছবির শুরু দিকে সোমনাথের যে দমবন্ধ হয়ে যাওয়া পরিবেশ দেখানো হয়েছে, সেখানে আরও কিছুটা বিল্ডাপের প্রয়োজন ছিল। তবে তা বাদ দিলে ছবিতে বেশ একটা স্নিগ্ধতা রয়েছে, যা প্রতিদিনের এই ছুটতে থাকা জীবনে বসার জন্য একটা গায়ের ছায়া আর কিছু পাখির গান ছেড়ে যাবে।ছবি: রাসপরিচালক: তথাগত মুখোপাধ্যায়অভিনয়ে: বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, দেবলীনা কুমার, রণজয় বিষ্ণুরেটিং: ৪.০/৫