‘অন্যান্য স্কুলের তুলনায় হিন্দু স্কুল থেকে পালানো কঠিন। স্কুলের বিল্ডিং আর গ্রুপ ডি স্টাফদের কোয়ার্টারের মাঝে সরু রাস্তা। উত্তর কলকাতার গলির মতো। সেখান দিয়ে বেশ কিছুটা গিয়ে সাত-আট ফুট উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের কিছুটা উপর দিয়ে ওয়াইএমসিএ ক্যান্টিনের অ্যাসবেস্টসের ছাদ ঢুকে এসেছে স্কুলের ক্যাম্পাসে। পাঁচিল টপকানোর জন্য নিচে ইঁট পাতা থাকত। ইঁটের উপর দাঁড়িয়ে পাঁচিল আর ওই ছাদের ফাঁক দিয়ে শরীর গলিয়ে পড়তে হত ক্যান্টিনের টেবিলগুলির পাশে।’ কথাগুলি বলছিলেন অফিসের সিনিয়র সুমনদা (সুমন রায়)। ‘কিন্তু এত কষ্ট করে স্কুল পালানো কেন?’ জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘শাহরুখ। ওর কুছ কুছ হোতা হ্যায় রিলিজ করেছে আর বন্ধুরা মিলে সেটা দেখব না তাও কি হয়! বহুবার এমন স্কুল পালিয়েছি আমরা, হিন্দু স্কুলের ছেলেরা। ’ নব্বইয়ের দশক পেরিয়ে নতুন শতাব্দী শুরু হচ্ছে তখন। উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে হলগুলির সামনে স্কুল ছাত্রদের থিকথিকে ভিড়। মূলত হিন্দু ও হেয়ার স্কুলের পডুয়া। মন্ত্র একটাই - ‘শাহরুখ শাহরুখ’!
স্টারডম যাকে ধরে রেখেছে
হংসরাজ কলেজ থেকে অর্থনীতিতে গ্র্যাজুয়েশন, জামিয়া মিলিয়া থেকে মাসকমে মাস্টার্স। পড়াশোনা করতে ভালোবাসেন, কিন্তু মন চায় অভিনয়। শেষমেশ মনের ডাকেই সাড়া দিলেন দিল্লির ওই যুবক। প্রথম ছবি ‘দিওয়ানা’ মুক্তি পেতেই সবাই দিওয়ানা। ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির আকাশে নতুন তারকা দেখা দিল। শাহরুখ। ভক্তদের ‘কিং’ খান। ৯০-র দশকে কাজ শুরু করেন শাহরুখ। প্রায় ৩০ বছর পেরিয়ে পৃথিবী অনেকটাই বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে ভারতের চালচিত্র। বদলেছে সিনেমাপ্রেমী জনগণের চাহিদা। স্টারডম থেকে কাহিনির ভরকেন্দ্রে সরে এসেছে সিনেমা। কিন্তু এসবের মাঝেও স্টারডম যিনি ধরে রেখেছেন, স্টারডম যাকে ধরে রেখেছে, আর স্টারডম বলতেই জনগণ যাকে ‘ধরে’ রেখেছেন, তিনি কিন্তু শাহরুখ।
‘জেন্টলম্য়ান রাজু’
১৯৯২ সাল থেকে একের পর এক হিট শুধু মানুষ টানার কৌশলে ভরপুর, তা নয়। জেন্টলম্য়ান রাজুর মতোই সাধারণ মানুষের কাহিনি ফুটে উঠেছে পর্দায়। যেসব মানুষ রোজ হারেন, রোজ অপমানিত হন, রোজই তাদের জীবনে দুঃখ আসে। আবার চকলেট পাওয়া বাচ্চাদের মতোই যারা আনন্দে ফেটে পড়ে। সেইসব মানুষের গল্প ফিরে ফিরে এসেছে। ‘নৈতিকতার জয়’, ‘প্রেমের জয়’, ‘হ্যাপিং এন্ডিং’ বা ‘ট্র্যাজিক’ কাহিনির মধ্যে দিয়েই সাধারণ দর্শকদের রাজা হয়ে উঠলেন পরিশ্রমে বিশ্বাসী শাহরুখ।
চাঁদেও গ্রহণ লাগে
এ হেন তারকার কেরিয়ার গ্রাফ যে সবসময় গ্রিন সিগনাল পেয়ে হোঁচট না খেয়ে তরতরিয়ে এগিয়েছে, তাও নয়! চাঁদেও গ্রহণ লাগে। শাহরুখের জীবনেও এসেছিল তেমন সময়। কোভিডকালের চার বছর তার সাক্ষী। ২০১৮ সালে মুক্তি পেল জিরো। ভাঁটা বক্স অফিসে। ভাঁটা সিনেমা হলে, মানুষের জোয়ারে, আগ্রহে। দেখতে দেখতে কেটে গেল চার বছর। ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল। লাল সিং চাড্ডা-সহ নানা সিনেমায় স্পেশাল অ্যাপিয়ারেন্সে দেখা যাচ্ছে কিং খানকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না সেই অভিনেতাকে, হিরোকে, দেখা যাচ্ছে না শাহরুখকে!ইতিমধ্যে অভিনেতা জড়িয়ে পড়লেন বিতর্কেও। কপালে ভাঁজ ফেলল পুত্র আরিয়ানের বিরুদ্ধে মাদক সংক্রান্ত মামলার জের। সমালোচকদের অনেকের মনে হয়েছিল শাহরুখের সময় বোধহয় ফুরোল। দীর্ঘ অ-দেখায় ভক্তদের মনখারাপ। কিং খানকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন কি এবার ভেঙে খান খান হওয়ার পালা?
‘ডোন্ট আন্ডারেস্টিমেট দ্য পাওয়ার…’
এমন গুজবেরই মাঝেই কাট টু পাঠান মুক্তির বছর — ২০২৩ সাল। বক্স অফিসের অঙ্ক ভুলে যাই বরং। নজর রাখি মানুষের উন্মাদনায়। ‘পাঠান’ মুক্তির দিন ভোর থেকে হলে হলে লাইন। ভারতের প্রায় সব বড় শহরে এই দৃশ্য়। বাদ পড়েনি কলকাতা। দর্শকের লাইন ছাড়াও কাকভোরে সিনেমা হলে হাজির ফ্যান ক্লাবের বিশাল বিশাল দল। কিং খানের কামব্যাক উদযাপন! চারদিন পর মিডিয়াকে শাহরুখ বলেছিলেন, ‘এই চার দিন আমাকে গত চার বছর ভুলিয়ে দিয়েছে।’ ‘পাঠান’-এর পর থেকে এখনও পর্যন্ত স্বমহিমায় শাহরুখ। হয়তো আর খেতে হবে হোঁচট, কেরিয়ারে আসবে না এমন ভাঁটা। বা হয়তো আসবে। বারবার আসবে। কিন্তু একইসঙ্গে ফিরে ফিরে আসবেন শাহরুখ। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, ‘There Is Only One Religion In World, Hard Work (পৃথিবীতে একটাই ধর্ম, কঠোর শ্রমে)’। ফিরবেন পরিশ্রমী একজন ‘কমন ম্যান’ হয়ে। যার ‘পাওয়ার’কে কখনও ‘আন্ডারেস্টিমেট’ করা যায় না!