সঙ্গ দেবার জন্য কোনো হাত নেই আর কোথাও,
সংগোপনের মন বুঝবার মন—
কিসের ওপর ভর করেছ হদিশ তো নেই তারও
দাহর পরে দাহই অনুক্ষণ।
—শঙ্খ ঘোষ
বাংলা সাহিত্যের একটা যুগ যেন হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে গেল। করোনা কেড়ে নিল আরও এক নক্ষত্রকে। সত্যি তো, আকাশের নক্ষত্রের স্থানেই তো আজ থেকে দেখা মিলবে প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষের। বিপ্লব ছিল রক্তে। যা ঝলকে পড়ত লেখায়। কবির লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হত তরুণ সমাজ। পেত এক নতুন বল।
অবিভক্ত বাংলার চাঁদপুরে ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জন্ম হয় কবির। আসল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক পাশ করেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অধ্যাপনাকে। শিয়ালদহের বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের প্রিয় ছিলেন শঙ্খবাবু।
দেশভাগের সময় গর্জে উঠেছিল কবির কলম। তারপর বাংলা যখন ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে তখনও থেমে থাকেনি তা। একটার পর একটা কালজয়ী কবিতা উপহার দিয়েছেন পাঠকদের। মধ্যবিত্ত বাঙালির মনন তাঁর মতো করে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। সাধারণের নিজেকে নিয়ে দ্বন্দ্ব, আলো-অন্ধকারে ঘেরা জীবন, প্রবঞ্চনা-ভালোবাসার চেনা ছকই অচেনা হয়ে ধরা দিত তাঁর সৃষ্টিতে।

কবিতার পাশাপাশি গদ্যও লিখতেন তিনি। আসলে গদ্য হোক বা পদ্য, শঙ্খ ঘোষের প্রতিটি রচনায় থকাত এক অনন্য রসবোধ, বৈদগ্ধতার পরিচয়। যা পাঠকের মনকে শান্ত করে। নতুন করে ভাবতে শেখায়। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেয়।
রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ পরবর্তী সময়ে বাংলা আধুনিক কবিতার পঞ্চপাণ্ডব ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপল কুমার বসু এবং শঙ্খ ঘোষ। প্রথম চারজনকে আমরা আগেই হারিয়েছি। আর এবার শঙ্খ ঘোষের বিদায় শেষে হয়ে গেল সাহিত্যের একটা যুগের। ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘উর্বশীর হাসি’, ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’-এর মতো কাব্যগ্রন্থ কবি উপহার দিয়েছেন পাঠককে।
‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান তিনি। ১৯৭৭-এ ‘মূর্খ বড়, সামাজিক নয়’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পান নরসিংহ দাস পুরস্কার। ১৯৮৯ সালে ‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য শঙ্খবাবুর হাতে তুলে দেওয়া হয় রবীন্দ্র পুরস্কার, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’-এর জন্য পেয়েছিলেন সরস্বতী পুরস্কর। ২০১৬ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ও ২০১১-য় ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে সম্মানিত হন শঙ্খ ঘোষ।