- দেবক বন্দ্যোপাধ্যায়
সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মিডিয়া ভ্যালু। সংবাদ মাধ্যমের পরিচিত শব্দ। এর মানে কী? সোজা কথায় বিনা খরচে খবরের কাগজের পাতা বা নিউজ চ্যানেলের হুইল জুড়ে থাকার মানে হল মিডিয়া ভ্যালু। বিনা খরচ? মানে বিজ্ঞাপনের জন্য টাকা গুণতে হল না। এমনকী পাবলিক রিলেশনসের জন্যও চার আনা খরচ হল না। তাহলে কি সংবাদ মাধ্যম যখন যাঁকে পাতা জুড়ে বা চ্যানেল জুড়ে দেখায় তাঁকে এমনি এমনি দেখায়? না। কখনও নয়। সেই ব্যক্তি বা সেই ইস্যু বা সেই ঘটনা তার সারকুলেশন বা টিআরপি বাড়ায় বলেই দেখায়। সারকুলেশন বা টিআরপি কেন বাড়ায়? কারণ ‘পাবলিক’ পড়তে চায়, দেখতে ও শুনতে চায়। সব মিলিয়ে মিডিয়া ভ্যালু হল সেই ‘ভ্যালু’ যা সরাসরি না হলেও ঘুরপথে মিডিয়া পেয়ে যায়।
(কাট টু বাংলার রাজনীতি)
বাংলার শেষ কয়েক দশকের রাজনীতিতে এ হেন মিডিয়া ভ্যালু উপভোগ করেছেন দু'জন। এক, জ্যোতি বসু; দুই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বসুর আমলে নিউজ চ্যানেলের এত বাড়বাড়ন্ত হয়নি। তাঁকে নিয়ে খবর মানে খবরের কাগজকেই বোঝাত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রিন্ট মিডিয়া যেমন পেয়েছেন, তেমনই পেয়েছেন বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যম। হালের ডিজিটাল মাধ্যমটিও পরখ করছেন তিনি।
এই দুই রাজনীতিকের থেকে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় শত হস্তে দূরে দিলীপ ঘোষ। একবার বিধায়ক হয়েছেন, একবার সাংসদ ও একবার তাঁর দলের রাজ্য সভাপতি। এই দিক থেকে দেখলে বসু ও মমতার মতো জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উচ্চতার সঙ্গে তাঁর কোনও তুলনাই চলে না। তবু শুধুমাত্র মিডিয়া ভ্যালুর প্রশ্নে দুই মহারথীর সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়িয়ে পড়েছেন দিলীপ ঘোষ।
তিনি হিন্দুত্বের প্রচারকের পরিমণ্ডল থেকে যে ধরনের পোড় খাওয়া পেশাদার রাজনীতিকদের বৃত্তে এসে পড়েছিলেন, তাতে রীতিমত ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার কথা ছিল তাঁর। তা হয়নি। উল্টে অনুব্রতদের মতো নেতাদের চড়াম চড়াম কথাবার্তার পাল্টা মানানসই শব্দ দিলীপের মুখের ভাষা হয়ে ওঠে। মলাটহীন স্পষ্ট। তাঁর চোখের চাহনি, শরীরী ভাষা এবং মুখের কথা কেউ কেউ পছন্দ করে ফেলেন, কেউ করেন না। কিন্তু তাঁকে অস্বীকার করতে পারেন না কেউই। গ্রামে গ্রামে দিলীপ ঘোষের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। তৃণমূল বিরোধী মানুষ, শাসক দলের কোনও কোনও নেতার দমন পীড়নে সহ্যের শেষ সীমায় দাঁড়ানো মানুষ সহসা ভরসা পেয়ে যায়। আর ঠিক তখনই পশ্চিমবঙ্গের বুকে নতুন এক নেতার জন্ম হয়। দিলীপ ঘোষ। বামমনস্ক বাংলায়, মমতা-আবেগী বাংলায় অন্যতম এক রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবে উঠে আসেন তিনি।
সাংবাদিকদের যে কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে কালক্ষেপ করেন না। মুকুল রায় সম্পর্কে অন ক্যামেরা বললেন, ‘উনি এখন আমাদের কাস্টডিতে আছেন।’ আবার অতি সম্প্রতি নাম না করে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসা নেতাদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘ওদের আমরা পুষি’। বেপরোয়া, বেলাগাম। এই চরিত্রটির ওপর মিডিয়ার আকর্ষণ দুর্নিবার। রোজ সকালে তাঁর প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গী সংবাদ মাধ্যম। নিউজ চ্যানেলের সকালের প্রোডিউসারের চাপ কম। দিলীপ ঘোষের ‘ফিড’ ঢুকে গেলেই নিশ্চিন্ত!
সম্প্রতি বিয়ে করে খবরের দুনিয়ায় ঝড় তুলেছেন। ঘরোয়া বিয়ে। সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ। তবু বাংলা সংবাদ মাধ্যমের প্রায় সকলে তাঁর বাড়ির দিকে ক্যামেরা তাক করে বসে রইল!
এরপর তিনি গেলেন দীঘা। সম্ভবত এই প্রথম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে অন্য কেউ মিডিয়ার আলো কেড়ে নিলেন!
২০২৪-এর পর থেকে কার্যত তিনি কেদারাবিহীন। না সাংসদ না বিধায়ক। না দলের কোনও পদে। চেয়ার ছাড়া সংবাদ মাধ্যমের এতটা আলো কেড়ে নেওয়া নেতা আর কত জন এসেছেন রাজ্য রাজনীতিতে?
একটা কথা দিয়ে শেষ করা যাক। প্রশ্ন উঠছে, দিলীপ ঘোষ কি তৃণমূলে যেতে পারেন? যে কথা দিয়ে এই লেখা শুরু হয়েছিল, সেই কথাতেই ফিরে আসা যাক। মিডিয়া ভ্যালু। যা এত দিন উপভোগ করেছেন দিলীপবাবু। রাজনৈতিক দলবদল হলে কি তাঁর সেই মিডিয়া ভ্যালু থাকবে? অতি বড় নির্বোধও জানে, তার সম্ভাবনা কতটা ক্ষীণ। অজান্তে অথবা সযত্নে লালিত এহেন মিডিয়া ভ্যালু নষ্ট করার মতো আহাম্মক আর যিনিই হন না কেন, দিলীপ ঘোষ নন।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
(দেবক বন্দ্যোপাধ্যায় ২৯ বছর সাংবাদিকতা করছেন। টাইমস অফ ইন্ডিয়া’য় পেশাগত হাতেখড়ি, তার পরে ‘নিউজ টাইম’, ‘লুক ইস্ট’, ‘নর্থ ইস্ট টেলিভিশন’-সহ আরও বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন তিনি। বেশ কিছু সময় সামলেছেন সম্পাদকের দায়িত্বও। বর্তমানে সাংবাদিকতার পাশাপাশি কয়েকটি বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমে রাজনীতির বিশ্লেষক।)