দীর্ঘ পাঁচ দশকের বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনে ইন্দিরা গান্ধী থেকে সনিয়া গান্ধী, কংগ্রেস নেতৃত্বের পুরোভাগে স্বমহিমায় বিরাজ করেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ছিল তাঁর সঙ্গে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সম্পর্ক।রাজধানীর ক্ষমতার অলিন্দ্যে মুখরোচক চর্চা শোনা যায়, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও বঙ্গসন্তানকে ‘স্যর’ সম্বোধন করতেন মনমোহন। আসলে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অধীনে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার ফলে এই ডাক তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ‘স্যর’ সম্বোধন করায় চূড়ান্ত অস্বস্তিতে পড়েন প্রণব। শেষ পর্যন্ত তাঁকে স্বস্তি দিতেই ‘প্রণবজি’ হিসেবে ডাক পালটান মনমোহন। উলটো দিকে, তাঁকে চিরকাল ‘ডক্টর সিং’ বলেই ডেকে গিয়েছেন কীর্ণাহারের একরোখা ব্রাহ্মণ। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের অধীনে কঠিন পরিশ্রম করলেও ইউপিএ মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যের মতো সনিয়া গান্ধীর প্রতি আনুগত্যের পাল্লা বরাবর ঝুঁকেছিল প্রণববাবুর। মন্ত্রিসভায় অমিতশক্তির অধিকারী প্রণব মুখোপাধ্যায় সপ্রতিভ নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রতিরক্ষা, অর্থ এবং বিদেশ মন্ত্রকের। ইউপিএ সরকারের যাবতীয় নীতি নির্ধারণ ও সমস্যা সমাধানে সিদ্ধহস্ত ক্ষমতাধর ‘গ্রুপ অফ মিনিস্টার্স’-এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে দুর্নীতি দমন থেকে ২০০৮ সালের অর্থনীতি চাঙ্গা করার প্যাকেজ, সব বিষয়েই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অগ্রণী ভূমিকা ছিল অপরিহার্য।তবে একাধিক বিষয়ে মনমোহনের সঙ্গে প্রণবের মতান্তরও যে ঘটেনি, তা বললে সত্যের অপলাপ হবে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে প্রণব-ঘনিষ্ঠ কূটনীতিকদের দাপট নিয়েও মাঝেমধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত অল্পবিস্তর ঘটতে দেখা গিয়েছে। তা সত্ত্বেও বিবিধ অর্থনৈতিক ও বৈদেশিক ইস্যু নিয়ে নির্দ্বিধায় অগ্রজ রাজনীতিকের পরামর্শ নিতে কখনও কুণ্ঠা বোধ করেননি মনমোহন সিং। ২০১১ সালে ভারত বনাম পাকিস্তান ক্রিকেট টি২০ ম্যাচ দেখতে মোহালি সফরের ইচ্ছা প্রকাশ করেন তদানীন্তন পাক প্রধানমন্ত্রী। এই বিষয় মন্ত্রিসভার বর্ষীয়ান সদস্য প্রণববাবুর কাছে পরামর্শ চান মনমোহন সিং। প্রণববাবু তাঁকে সাফ বলেন, ‘গুরুতর দ্বিপাক্ষিক বিষয় ছাড়া যে কোনও বিষয়ে কথা বলতে পারেন।’সেই সঙ্গে, ক্রিকেটের নতুন জনপ্রিয় ফরম্যাট সম্পর্কে ধারণা ছিল না বলেই সারাদিন স্টেডিয়ামে বসে ধৈর্য ধরে ক্রিকেট দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুখ্যাতি করেছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়ার পরে মনমোহন সিংয়ের প্রধান সচিব টিকেএ নায়ার জনান্তিকে জানিয়েছিলেন, ২০১২ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে বিতর্কিত আত্মসমীক্ষামূলক কর প্রদান নীতি চালু করার পিছনেও প্রণববাবুরই মস্তিষ্ক কাজ করেছিল। আসলে তাঁর মতো অভিজ্ঞ ও বিরাট মাপের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পরামর্শ উড়িয়ে দিতে পারেননি বলেই তাতে সায় দিতে হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে।