ভোটার আইডি কার্ড থাকলেই কি নাগরিকত্ব প্রমাণ হয়? গত এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন আদালতে পরস্পরবিরোধী রায় দেওয়ায় এখন এই প্রশ্ন উঠছে।১২ ফেব্রুয়ারি গৌহাটি হাই কোর্ট নিজেদের পুরনো রায়ের ভিত্তিতে বলে যে ভোটার আইডি কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। মুনিন্দ্র বিশ্বাস বলে একজন আদালতে মামলা করেন এই বলে যে তাঁর নাম ভোটার তালিকায় আছে। অতএব তিনি বৈধ নাগরিক। কিন্তু সেই কথা মানতে চায়নি গৌহাটি হাই কোর্টের বেঞ্চ। অসম রাজ্য বনাম বাবুল ইসলাম মামলার রায়ের ভিত্তিতে নিজেদের বিচার শুনিয়েছে আদালত।১৯৯৭ সালের ভোটার স্লিপের কাগজ জোগাড় করেছিলেন মুনিন্দ্র। আদালত বলে যে এতে প্রমাণ হয় না ১৯৭১ সালের আগে অসমে ছিলেন তিনি বা তার পরিবার। অসম চুক্তি অনুযায়ী যারা ১৯৭১-এর আগে রাজ্যে এসেছে বাইরে থেকে তাদের অসমের নাগরিক হিসাবে মেনে নেওয়া হবে।একই দিনে আদালত আরেক ব্যক্তির নাগরিকত্বের দাবি খারিজ করে দিয়েছে। সে তাঁর বাবা-মার ভোটার লিস্টে নাম দেখিয়েছিল, কিন্তু তাদের সঙ্গে নিজের কোনও সম্পর্কের আইনি প্রমাণ দেখাতে পারেনি। প্যান ও ব্যাঙ্কের কাগজ মানেনি আদালত।২০১৮ সালে আদালত জানিয়েছিল যে কোনও অন্য প্রমাণ ছাড়া শুধু ভোটার আইডি কার্ড দেখালে সেটাকে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে মানা হবে না। অন্যদিকে ভোটার কার্ডকে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে গণ্য করেছে মুম্বইয়ের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ১৫ ফেব্রুয়ারির রায়ে। এক দম্পতির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে তারা বাংলাদেশী। সেখানে ভোটার আইডি কার্ডকে প্রমাণ হিসাবে গণ্য করেছে আদালত। বার্থ সার্টিফিকেট, ডোমিসাইল সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট ইত্যাদি কোনও মানুষকে শনাক্ত করার জন্য ব্যবহার করা যাবে বলে জানিয়েছে মুম্বইয়ের আদালত।ভোটার আইডি কার্ড নাগরিকত্বের বৈধ প্রমাণ বলে আদালতের যুক্তি যে কার্ড বানানোর সময় তো সবাইকে ডিক্লেয়ারেশন দিতে হয় যে তারা ভারতীয় নাগরিক। সেই ডিক্লেয়ারেশন ভুল হলে জেল পর্যন্ত হতে পারে।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক আগেই জানিয়েছে যে ভোটার কার্ড, আধার, পাসপোর্ট, এগুলি নাগরিকত্ব প্রমাণ করে না।সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শ্রীরাম পারাক্কাট এই কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তাঁর কথায়,' ভারতের চলতি আইন অনুযায়ী, ভোটার আইডি বা পাসপোর্ট নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। আমি বলছি না এটা নীতিগত ভাবে সঠিক। কিন্তু ২০০৩ সাল থেকে এইটি আইন। ভারতে কেউ জন্মেছে এই ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে ১৯৮৭ সাল থেকে। আধার, পাসপোর্ট, ভোটার আইডি প্রমাণ করে যে কেউ ভারতে জন্মেছে, সে নাগরিক কিনা, সেটা নয়।'২০০৩ থেকে আইনে কি বদল এসেছে ?নাগরিকত্ব আইনে বড় বদল এসেছে ২০০৩ সাল থেকে। সেই সংশোধনী অনুযায়ী, ভারতে ১৯৮৭ সালের পয়লা জুলাইয়ের পর ও ২০০৩-এর আগে যারা জন্মেছে, তাদের ভারতীয় হিসাবে তখনই গণ্য করা হবে যদি তাদের বাবা ও মা-র মধ্যে একজন ভারতীয় হয়। যাদের ২০০৩-এর পর জন্ম, তাদের বাবা-মা দুজনকেই ভারতীয় নাগরিক হতে হবে বা একজনকে নাগরিক হতে হবে ও অন্যজন যেন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী না হন।পারাক্কাট বলেন যে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত ভাবে একজন ভারতীয় নাগরিক, তা প্রমাণ করা খুব মুস্কিল। অন্যকেউ বলে দিতেই পারে যে আপনার নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে। বাবা-মা যে নাগরিক ও তাদের সঙ্গে সম্পর্কের প্রমাণ দেওয়া, এই সবকিছুতেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। অসমে এনআরসির পরে ফরেনার্স ট্রাইবাুন্যালে এই সমস্যা হচ্ছে বলে জানান পারাক্কাট।আরেক বিশেষজ্ঞ অলোক প্রসন্ন কুমার জানিয়েছেন যে অসমে দেওয়া রায়গুলিকে সবসময় অন্য রাজ্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে না। ওখানে নাগরিকত্ব আইনের ৬এ ধারা প্রযোজ্য, যেটি গোটা দেশে ব্যবহৃত হয় না। অসমে কাওর নাম ভোটার লিস্টে থাকলেই সে নাগরিক হয় যান না। তার পরিবার বা সে ১৯৭১-এর আগে ভারতে এসেছে, তার প্রমাণ দিতে হবে।তাহলে ভোটার আইডি কার্ডের প্রাসঙ্গিকতা কি?পারাক্কাট বলেছেন যে বাবা বা মায়ের নাম পাসপোর্ট বা ভোটার কার্ডে থাকে। সেটি দেখিয়ে কিছুটা সহজে নাগরিকত্ব প্রমাণ করা যেতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে করা যাবে না। আজকের দিনে একটাও তেমন নথি নেই, যাতে সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রমাণ হয় যে সেই ব্যক্তি ভারতীয়, বলেন পারাক্কাট।একই সঙ্গে তিনি বলেন যে সংবিধানের ১১ নম্বর ধারা অনুযায়ী সংসদের ওপর পুরো দায়িত্ব নাগরিকত্ব সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন করার। তাই NRC ইত্যাদি সংবিধান বিরোধী, এগুলি ওভাবে বলা চলে না। এরফলে মুম্বই আদালতের রায় ২০০৩ সালের নাগিরকত্ব আইনের সংশোধনীর বিপক্ষে যাচ্ছে বলে জানান আইনজীবী।গুয়াহাটি আদালতের রায় সাধারণ মানুষের হয়তো খারাপ লাগছে কিন্তু সেটির আইনি ও সাংবিধানিক ভিত খুবই মজবুত বলে জানিয়েছেন আইনজীবী।