এই তো সেদিন ‘করিব করিব সিঙ্গেল’ দেখলাম। এক মুহূর্তের জন্যেও কখনও মনে হয়নি যে অভিনয় করছেন! সবচেয়ে অবাক লাগে ওঁর সংলাপ বলার স্টাইল দেখে! কোনটা যে সংলাপ আর কোনটা এমনি কথা বলছেন বোঝা যায় না! এতটাই সাবলীল তিনি। অভিনয় আর বাস্তবের মধ্যে কোনও ফারাক করা যায়নি কোনও দিন। অত বড় মাপের শিল্পী শুধু আমাদের দেশেই নয় সারা বিশ্বে খুব কমই জন্মেছেন। ইরফান খান নেই, বা এখন থেকে ইরফান খান সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে ‘তিনি ছিলেন’ এই শব্দটা ব্যবহার করতে হবে এটা আমি ভাবতেই চাই না। ইরফান আমাদের মধ্যেই রয়েছে, এবং ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।যত বয়স বাড়ছিল ততই যেন আরও বেশি করে নিজেকে মেলে ধরছিলেন। ভারত এক খোঁজ, এক ডক্টর কি মওত, বিল্লু বারবার, পান সিং তোমর, থেকে শুরু করে পিকু কিম্বা আংরেজী মিডিয়াম, প্রত্যেকটা চরিত্রই যেন তাঁর জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। মীরা নায়ারের 'নেমসেক' ছবিতে কাজ করতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ। প্রথম দিনই মনে হয়েছিল যেন কত দিনের চেনা! খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জমে উঠেছিল সম্পর্কটা। শুটিংয়ের ফাঁকে যখন ব্রেক হত তখন আমার কাছে এসে বিড়ি চাইতেন। বিড়ি ওর খুব ফেভারিট। একদিন আমায় বললেন ‘টাব্বু আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়, কিন্তু আপনার সঙ্গে একেবারেই পরিচয় নেই তো, তাই নিজে থেকে এসে কথা বলতে একটু ইতস্তত করছে।‘ আমি তো শুনে অবাক! সেই মুহূর্তে টাব্বুর সঙ্গে ইরফান আমার আলাপ করিয়ে দেন। টাব্বু বলেন, সে নাকি আমার কথা অনেকদিন ধরেই জানেন। তাঁর বিশেষ বন্ধবী অভিনেত্রী চৈতি ঘোষালের কাছে আমার কথা শুনেছেন। সেই থেকেই আলাপ করার ইচ্ছে ছিল। এখানে কাজ করতে এসে আমাকে দেখে ইরফানকে বলেন আলাপ করিয়ে দিতে। তারপর থেকেই আমাদের সকলের মধ্যে দারুণ একটা বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যেটা কাজের ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। ইরফানের মতে, 'যদি বাস্তবে নিজেদের মধ্যে আমরা সাবলীল না হই, তাহলে স্ক্রিনেও আমাদের খাপছাড়া লাগবে।' শুটিং চলাকালীন ইরফান বারবার জিজ্ঞেস করতেন সব ঠিক আছে কিনা, কোথাও কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা, যদি কোনও অসুবিধা হয় তাহলে অবশ্যই যেন জানাই, ইত্যাদি। শট দেওয়ার পর জানতে চাইতেন ওঁর কোথাও কিছু ভুল হয়েছিল কিনা? সব ঠিকছিল তো?অসম্ভব নিখুঁত একজন অভিনেতা। একফোঁটাও ইগো নেই। সহ অভিনেতাদের কীভাবে সম্মান দিতে হয় তা ওঁর কাছ থেকে শেখার মতো। শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও এত ভদ্র, ডিসেন্ট এবং নমনীয় মানুষ মেলা বিরল। ইরফানের সম্বন্ধে যতই বলি, বা যাই বলিনা কেন সেটা কম বলা হবে। সোনার গয়নাতে সোনার রঙ করার মতো আর কি! তবে এইটুকু বলতে পারি এই ক্ষতির কোনও পূরণ নেই। ওঁর করা কাজ গুলো আমাদের এবং আগামী প্রজন্মের কাছে শিক্ষাসম। আবারও বলছি, আমি মানতেই চাই না, ইরফান খান আমাদের মধ্যে নেই।