বৃহস্পতিবার যখন মুম্বইয়ে প্রয়াত শিল্পপতি রতন টাটার অন্তিম যাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, ঠিক সেই সময় সমগ্র জামশেদপুর শহরই যেন শোকের আবহে ডুবে গিয়েছে!
এদিন শহরের নানা প্রান্তে দলে দলে জমায়েত করেন স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে টাটা গোষ্ঠীতে কর্মরত কর্মী, আধিকারিক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। উদ্দেশ্য একটাই - সদ্য প্রয়াত টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্য়ান এবং টাটা সন্সের প্রাক্তন চেয়ারম্যান শ্রী রতন টাটার প্রতি অন্তিম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।
উল্লেখ্য, রতন টাটা নিজে বরাবরই জামশেদপুরকে তাঁর 'দ্বিতীয় বাড়ি' বলে উল্লেখ করতেন। এখানকার বাসিন্দারাও নিজেদের রতন টাটার সম্প্রসারিত পরিবারের সদস্য বলেই বিশ্বাস করেন।
জামশেদ পুরের ইতিহাস বলছে, এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জডিয়ে রয়েছেন রতন টাটা। আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিটেকচার ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর, ১৯৬২ সালে এই জামশেদপুরেই দু'টি বাড়ির নকশা তৈরি করেছিলেন রতন টাটা।
তার মধ্যে একটি বাড়ি হল টাটা স্টিলের প্রাক্তন এমডি ড. টি মুখোপাধ্যায়ের এবং অন্যটি হোটেল মানসরোবরের মালিকের। এই দু'টি বাড়িই নির্মাণ করা হয়েছিল পূর্ব জামশেদপুরের ১০ নম্বর সার্কিট হাউস রোডের পাশে।
এই ঘটনা যখন ঘটে, তখন রতন টাটা বয়সে যুবক। সালটা ছিল, ১৯৬৩-৬৪। শিক্ষানবীশ হিসাবে, রতন টাটা সবেমাত্র যোগ দিয়েছেন টাটা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড লোকোমোটিভ কোম্পানি (টেলকো)-তে। বর্তমানে যা এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে - টাটা মোটর্স রূপে।
বৃহস্পতিবার হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. মুখোপাধ্যায় বলেন, 'জামশেদপুরের সার্কিট হাউস অঞ্চলে আমি যে একটি বাড়ি পেয়েছি, এবং সেই বাড়ি যে স্বয়ং রতন টাটার নকশা অনুসারে নির্মাণ করা হয়েছে, এর জন্য আমি নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে করি।'
ড. মুখোপাধ্যায়ের সেই বাড়িটি ঠিক কেমন? জবাবে তিনি জানিয়েছেন, 'এই বাড়িতে প্রচুর জায়গা রয়েছে। একতলার রয়েছে একটি রান্নাঘর, বৈঠকখানা এবং একটি শোওয়ার ঘর। বাদবাকি ঘরগুলি রয়েছে বাড়ির দোতলায়।'
ড. মুখোপাধ্যায় আরও জানান, রতন টাটা শুধুমাত্র তাঁর বাড়ি নয়, সেইসঙ্গে মুম্বইয়ের নিজের বাড়ির নকশাও নিজেই তৈরি করেছিলেন। সেই বাড়িটি হল সমুদ্রমুখী। সেই বাড়িতেই জীবনে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত (হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত) রতন টাটা বসবাস করেছেন। সেই বাড়িটিও অত্যন্ত খোলামেলা। ওই বাড়িতে যে সুইমিং পুলটি রয়েছে, সেটি প্রায় আরব সাগরের তট পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এছাড়াও, ড. মুখোপাধ্য়ায় জানান, রতন টাটা তাঁর আলিবাগের বাড়ি এবং মুম্বইয়ে তাঁর মায়ের বাড়ির নকশাও নিজে তৈরি করেছিলেন।
রতন টাটা বিমান চালাতে খুব ভালোবাসতেন। যখনই সুযোগ পেয়েছেন নানা ধরনের বিমান চালিয়েছেন। তাঁর এই ভালোবাসার কথা হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন টাটা স্টিলের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিরূপ মোহান্তি।
বৃহস্পতিবার আমাদের প্রতিনিধিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'রতন টাটা বিমান চালাতে খুব ভালোবাসতেন। তিনি জানতেন আমারও ওই একই সখ রয়েছে। একবার আমি তখন সোনারি বিমানবন্দরে, অপেক্ষা করছি একটি বিমানের পরীক্ষামূলক উড়ানে অংশ নেব বলে। সেই সময়েই অন্য একটি বিমান থেকে নামলেন রতন টাটা। তিনি যখন জানতে পারেন, আমি সেখানে বিমানের পরীক্ষামূলক উড়ান করছি, তিনি হেসেছিলেন এবং আমাকে শুভকামনা জানিয়েছিলেন।'
নিরূপ মোহান্তি আরও জানান, টাটা স্টিলের কাছে সেই সময় একটি নতুন বিমানের মডেল এসেছিল। সেটির প্রপেলারে চারটি ব্লেড ছিল। তার আগে পর্যন্ত টাটা স্টিল যে ধরনের বিমান ব্যবহার করত, সেগুলি প্রপেলারে থাকত তিনটি করে ব্লেড।
উড়ানের দিক থেকে বিচার করলে, নতুন ধরনের ওই বিমানে, ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রপেলারও বন্ধ হয়ে যেত এবং তার ফলে যে টান তৈরি হত, তার জন্য অবতরণের সময় একটি বেশি শক্তির প্রয়োজন হত।
নিরূপ জানান, রতন টাটা এই নয়া মডেলের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। ফলে অবতরণের সময় তাঁকে একটু বেশিই জোর দিতে হয়েছিল। সেই বিষয়টি নিরূপ মোহান্তিই রতন টাটার কাছে ব্যাখ্যা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার জন্য আজও তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, 'যখন আমি টাটা স্টিল ছাড়ব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, রতন টাটা সংস্থার এক সিনিয়র এগজিকিউটিভের কথা বলেন। তাঁকে বলেন, আমি যাতে টাটা গোষ্ঠীর যেকোনও সংস্থায় নিজের পছন্দ মতো পদ বেছে নিই, আমাকে সেই প্রস্তাব দিতে!'
রতন টাটার পশুপ্রেমও কারও অজানা নয়। সেই সম্পর্কে হিন্দুস্তান টাইমসকে ফোনে নিজের অভিজ্ঞতা শোনান টাটা স্টিল কর্পোরেট কমিউনিকেশনের প্রাক্তন প্রধান সঞ্জয় চৌধুরী।
তিনি বলেন, 'রতন টাটা যতটা ভালোবাসতেন নতুন বাড়ি তৈরি করতে কিংবা তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে, ঠিক ততটাই ভালোবাসতেন পশু, পাখি এবং পরিবেশ। শুধুমাত্র কুকুরের চিকিৎসার জন্য মুম্বইয়ে ১৬৫ কোটি টাকা খরচ করে তিনি একটি হাসপাতাল গড়ে তোলেন।'
একইসঙ্গে সঞ্জয় জানান, ওড়িশার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক যখন ভুবনেশ্বরে ইনস্টিটিউট অফ ম্যাথেমেটিক্স গড়ে তোলেন, তখন সেই ভবনের নির্মাণে অংশ নেন রতন টাটা। যা থেকে বোঝা যায়, সুন্দর ভবন তৈরি করতে তিনি কতটা ভালোবাসতেন।
১৯৯৩ সালে টাটা স্টিলের চেয়ারম্যান হন রতন টাটা। কর্মসূত্রে জামশেদপুরে তাঁর আসা-যাওয়া লেগেই থাকত। ১৯৯৪-৯৫ সালে ঝাড়খণ্ডের পশ্চিম সিংভূম জেলার নোয়ামুণ্ডিতে লৌহ আকরিক খনি পরিদর্শনে এসেছিলেন রতন টাটা।
সেই সময়ে তিনি বলেছিলেন, যেভাবে দ্রুত গতিতে বিশ্বায়ন ঘটছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য টাটা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থাকে একটি নির্দিষ্ট বহুজাতিক ব্র্যান্ডের অধীনে নিয়ে আসা জরুরি। উল্লেখ্য, সেই সময় টাটা স্টিল এবং এই অন্য সংস্থাগুলি আলাদা-আলাদাভাবে পরিচালিত হত।
তথ্য বলছে, নিজের ৮৬ বছরের জীবনকালে মোট ২৬ বার জামশেদপুর এসেছিলেন রতন টাটা। ২০১৯ সালে মেহরাবতী টাটা মেমোরিয়া হাসপাতালের উদ্বোধন হয়, সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তিনি। শেষবার রতন টাটা জামশেদপুর এসেছিলেন ২০২১ সালের মার্চ মাসে। উপলক্ষ্য ছিল, সংস্থার ১৮২তম প্রতিষ্ঠা দিবস।