মধ্যপ্রাচ্যের উত্তাপের আঁচ গনগনে। ইজরায়েল এবং ইরানের সংঘাত সপ্তম দিনে পড়েছে। সেই আগুনে ঘি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। তেল আভিভ ও তেহরানের মধ্যে এই সম্পর্ক যে গোড়া থেকে ছিল, এমনটা নয়। একটা সময়ে শিয়া মুলুকটিতে বন্ধু রাষ্ট্র বলেই ভাবতেন ইহুদিরা। কিন্তু, ১৯৭৮-৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়।ইরানের এই ইসলামীয় বিপ্লবের জনক ছিলেন রুহোল্লা মুসাভি খোমেইনি। বিপ্লবের পর তিনিই ছিলেন সে দেশের সর্বোচ্চ নেতা। যাঁর সঙ্গে ভারতের বা আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে উত্তরপ্রদেশের বারাবাঁকি জেলার কিন্টুর গ্রামের রয়েছে আত্মার সম্পর্ক।
সময়টা আনুমানিক ১৮০০ সালের আশপাশে। রুহোল্লা খোমেইনির দাদু সৈয়দ আহমদ মুসাভি হিন্দির জন্ম হয় লখনউ থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে বারাবাঁকির ছোট্ট গ্রাম কিন্টুরে। ধর্মপ্রাণ সৈয়দ পরবর্তীতে শিয়া ধর্মগুরু হয়ে ওঠেন। তাঁর আগের প্রজন্মই ইরান থেকে ভারতে চলে এসেছিল। কিন্তু ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই মুঘল সাম্রাজ্যের প্রভাব ফিকে হতে শুরু করে।আর সেই সন্ধিক্ষণেই ১৮৩০ সালে কিন্টুর থেকে ইরাকের নাজাফের উদ্দেশে রওনা দেন সৈয়দ। শিয়া মুসলিমদের কাছে নাজাফ অন্যতম পবিত্র শহর। পয়গম্বর মহম্মদের জামাতা ইমাম আলির (প্রথম ইমাম) সমাধিক্ষেত্র সেটি। ইমামের সমাধিক্ষেত্র দেখতেই নাজাফ পৌঁছন সৈয়দ। কিন্তু সেখান থেকে আর ফেরেননি তিনি।তবে খামেইনির দাদু আজীবন তাঁর পদবিতে ‘হিন্দি’ শব্দটি ব্যবহার করে গিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে নাড়ির টান বোঝাতে পদবিতে এটি ব্যবহার করতেন তিনি। এমনকি ইরানের সরকারি রেকর্ডে আজও তাঁর নামের পাশে ‘হিন্দি’ লেখা রয়েছে।
এর কয়েক বছরের মধ্যেই ইরানের খোমেইন শহরে আশ্রয় নেন তিনি। সেখানেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, সন্তান হয় তাঁদের। ইরানের শিয়া ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ভালই পরিচিত হয়ে ওঠেন সৈয়দ। ১৮৬৯ সালে মারা যান সৈয়দ। কারবালায় সমাধিস্থ করতে হয় তাঁকে। কিন্তু তাঁর ধর্মশিক্ষা, তাঁর আদর্শ আজও বহন করে চলেছে ইরানের শিয়া সমাজের বড় অংশ। পরবর্তী সময়ে ইরানের ভিত্তিও গড়ে ওঠে সেই আদর্শের উপরই। সৈয়দের ছেলে মুস্তাফা হিন্দির ছেলেই প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা রুহল্লা খোমেইনি। ১৯০২ সালে রুহল্লার জন্ম হয়। তিনি ইসলামি বিপ্লবের জনক এবং দেশের প্রথম সর্বোচ্চ শাসক। ছয়ের দশকে পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হন রুহল্লা। শাহ মহম্মদ রেজার পেহলবির ঘোর সমালোচক ছিলেন তিনি। বলা হয়, দাদুর সঙ্গে দেখা না হলেও সৈয়দের বিচারবুদ্ধির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠেন রুহল্লা। ১৯৭৯ সালে পেহলবির পতন ঘটলে রুহল্লাকে সামনে রেখেই বিপ্লব নেমে আসে ইরানে। কিন্তু ইরানের সর্বোচ্চ শাসক হয়ে ওঠার মধ্য়েই নিজের উদার ও মুক্ত চিন্তাকে সরিয়ে তিনি কট্টর ধর্মশাসনের সমর্থক হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ শোনা যায়।
ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ শাসক আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের জন্ম ১৯৩৯ সালে। ইরানের বিপ্লবের সময় খোমেইনির সান্নিধ্যে আসেন খামেনেই, তাঁর শিষ্য হয় ওঠেন। এমনকি, দূর সম্পর্কের হলেও, খোমেইনির সঙ্গে পারিবারিক সংযোগ রয়েছে খামেনেইয়ের। ভারত নিয়ে সেভাবে ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করেন না খামেনেই। তবে ইরানের অভিজাত মহলে তাঁর ভারত-সংযোগ নিয়ে চর্চা শোনা যায়। এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীর নজর ইরানের দিকে। যে কোনও মুহূর্তে পৃথিবীর ভূরাজনৈতিক সমীকরণ বদলে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।