Shantiniketan Poush Mela: বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইরেক্টর অফ স্টাডিজ পদে ছিলেন দীর্ঘকাল। এক বছর সামলেছেন উপাচার্যের পদও। বর্তমানে শান্তিনিকেতনের ট্রাস্টি তথা দর্শন বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা সবুজকলি সেন প্রায় ৫৪ বছর ধরে রয়েছেন শান্তিনিকেতনে। ৫০ বছর আগে দেখা তারকাখচিত পৌষ মেলা কেমন লেগেছিল তরুণী সবুজকলির? এখনই বা আয়োজক হিসেবে মেলাকে কীভাবে দেখেন প্রবীণা অধ্যাপিকা? HT বাংলায় অকপট কথালাপে তুলে ধরলেন সবটাই।
বেদীতে তখন শান্তিদেব, কণিকা
‘শান্তিনিকেতনে প্রায় ৫৪ বছর রয়েছি। ৭১ সালে ছাত্রী হিসেবে শিক্ষাভবনে আসি। তার আগে একবার ক্লাস সেভেনে মেলা দেখতে নিয়ে এসেছিলেন বড়রা। তখন ভাঙা মেলা চলছিল। তাই মূল অনুষ্ঠান দেখতে পারিনি। তখনকার দিনে মানুষরা গরুর গাড়ি করে আসত। মেলা শুরুর আগের দিন সন্ধ্যেয় একটা বৈতালিক হত। এখন বৈতালিক যেমন মন্দির ও শান্তিনিকেতন গৃহের কাছে গৌরপ্রাঙ্গণে এসে থামে। তখন গৌরপ্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে মন্দির পরিক্রমা করে সঙ্গীত ভবন পর্যন্ত যেত। ‘আজি যত তারা তব আকাশে’ গাওয়া হত। পরদিন ভোর পাঁচটায় অনুষ্ঠিত বৈতালিকের গানটা আজও মনে গেঁথে আছে — ‘দাঁড়াও আমার আঁখির আগে’। ছাতিমতলায় তখন গান গাইতেন ওস্তাদজি (ওস্তাদ ওয়াজেলওয়ার) আর মন্ত্র উচ্চারণ করতেন বাজপেয়ীজি (মোহনলাল বাজপেয়ী)। বেদীতে তখন গান গাইতেন দিকপাল মানুষেরা। আমি যেমন দেখেছি শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন।’
ভায়োলিনে রবীন্দ্রসংগীত
নাম বিস্মৃত হওয়া এক ব্যক্তি ভেসে উঠলেন সবুজকলির স্মৃতিচারণে। ‘তখন সেন্ট্রাল অফিসে এত বেড়া ছিল না। তিনদিনের মেলায় চন্দননগর ( বা হয়তো মধ্যমগ্রাম) থেকে একজন আসতেন। তিনি ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে ভায়োলিনে রবীন্দ্রসংগীত বাজাতেন। আমার মতো যারা শান্তিনিকেতনের পুরনো আশ্রমিক, তাদের সকলেরই তাঁকে মনে থাকবে। মেলায় পুলিশের অফিস এখন যেখানে হয়, সেখানে তখন ছিল কাঠের নাগরদোলা। অমল পালেকর থেকে শ্যাম বেনেগাল অনেককেই নাগরদোলায় চড়তে দেখেছি। তাঁদের দেখার জন্য তখন এত ভিড় হত না। ফলে তাঁরাও নিশ্চিন্তে মেলায় ঘুরতেন। ‘কণ্ঠস্বর’ বলে কলকাতা থেকে একটা দল আসত। তারাও তিনদিন রবীন্দ্রসংগীত গাইত। মেলার তিনদিনই অবশ্য শান্তিদেব ঘোষ মঞ্চে থাকতেন। তাঁর পরীক্ষিত মানুষ ছাড়া পৌষ মেলার মঞ্চে কেউ গান গাইত না। রাতের দিকে যাত্রা হত। সে কথাও মনে পড়ে।’
মেলা নিয়ে বিতর্ক
মেলার কতটা কীভাবে বদলেছে এই ৫০ বছরে? সবুজকলি জানাচ্ছেন, ‘মেলা যুগের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায়। নানা সময় এই বদল নিয়ে বিতর্কও হয়েছে। একবার ট্রাক্টরের প্রদর্শনী হল মেলার মাঠে। তখন সবুজ বিপ্লবের যুগ। ওই প্রদর্শনী নিয়ে শান্তিনিকেতনের সঘোষিত ‘জ্যাঠ্যামশাই’রা (এঁরা শুধু শান্তিনিকেতনের ভিতরে থাকেন না, বাইরেও থাকেন) ব্যঙ্গ করলেন। বললেন, এরপর হয়তো রোলস রয়েসের প্রদর্শনীও হবে। সেটা কিন্তু হয়নি। মানুষের যা প্রয়োজন, তারই প্রদর্শনী হয় পৌষ মেলায়। তবে একটা জিনিসের এখন অভাব বোধ করি। টুপি, লাঠি, ছাতা এগুলোর স্টল মেলার পিছন দিকে বসত। তারা জানুয়ারি মাসেও বেশ কিছুদিন থাকত। বিশ্বভারতীর শিক্ষক ও কর্মীদের মাইনে হত ১ তারিখ। তারপর তারা ওই জিনিসগুলি কিনতে যেতেন। কাঠের দ্রব্যের ব্যবসায়ীরাও জানুয়ারির ওই শুরুর কিছুদিন থেকে জয়দেবের কেন্দুলির মেলায় চলে যেতেন।’
‘গ্রামের চরিত্রও বদলাচ্ছে’
গ্রামের চরিত্রও তো দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে। ফলে গ্রামবাসীদের জীবনযাপনেও বদল আসছে। যেমন এই বছর মেলায় গিয়ে দেখলাম স্টিলের বেলনচাকি বিক্রি হচ্ছে। প্রচুর সাঁওতাল মহিলারা সেগুলি কিনছেন। বছর সাত-আট আগে পর্যন্ত মেলা আমাদের কাছে অন্যরকম ছিল। তখন সারা বছর যা যা কিনতে পারছি না, মেলার সময় সেগুলি কিনতাম। শুধু আমি নয়, সমস্ত বোলপুর শান্তিনিকেতন, এমনকি বীরভূমের অনেকাংশের তাই পরিকল্পনা থাকত। কিন্তু এখন ভীষণভাবে অনলাইনের যুগ। কাঙ্খিত জিনিস কিছু দিনের মধ্যেই হাতে চলে আসছে। তাই মেলা থেকে কেনার ভাবনা আলাদা করে ততটা আসে না।
মেলায় বিউটি কম্পিটিশন
‘তখন মেলা হত মন্দিরের সামনের মাঠে। রবীন্দ্রনাথের সময়ও তিনদিন ওখানেই মেলা হত। ১৯৬১ সালে গুরুদেবের যখন শতবর্ষ, তার পর থেকেই ভিড় বাড়তে থাকল। এতটাই বাড়ল যে মেলাটা পূর্বপল্লীর মাঠে অর্থাৎ এখন যেখানে হয়, সেখানে চলে গেল। তখন বাজি পোড়ানো মেলার একটা বড় আকর্ষণ ছিল। গ্রামের লোকেদের কাছেও বড় আকর্ষণ ছিল বাজি। প্রচুর ভিড় হত ওই দিন। বাজি তৈরি করত সুরুলের লোকরা। মেলার চাহিদা কীভাবে বদলাচ্ছে, তা হয়তো আরেকটা উদাহরণে স্পষ্ট হবে। বছর দশ আগে একটা চুলের তেলের সংস্থার তরফে কিছু লোক আমার কাছে এল। তারা মেলায় একটা বিউটি কম্পিটিশন করছে। আমাকে বিচারক হিসেবে আমন্ত্রণ জানাল। সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতার ব্যাপারটাকে কোনওদিনই আমি সমর্থন করি না। তাই যাইনি। কিন্তু মেলার চাহিদা ও ক্রেতারা যে পাল্টাচ্ছে, তার আঁচ পেয়েছিলাম। আগে ছাত্রছাত্রীরা কফি আর খাবারের স্টল দিত। এখন সেটা অনেকটাই কমে গিয়েছে। মানসিকতার পরিবর্তন তো হবেই।’
কম্বল, চাল, ডাল, অর্থ বিতরণ…
শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট ১৮৮৮ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্থাপন করেন। শান্তিনিকেতন তো দেবেন্দ্রনাথের ব্রহ্মসাধনার স্থল ছিল। ফলে তাঁর মনের একটা ইচ্ছা ছিল, এখানে ভক্ত সাধকরা আসবেন, উপাসনা করবেন, ধর্ম নিয়ে আলোচনা করবেন। সেই উদ্দেশ্যেই উপাসনাগৃহ তৈরি হয়। দেবেন্দ্রনাথের ট্রাস্ট ডিডে স্পষ্ট লেখা রয়েছে ‘…ট্রষ্টীগণ বর্ষে বর্ষে একটি মেলা বসাইবার চেষ্টা ও উদ্যোগ করিবেন। এই মেলাতে সকল ধর্ম্ম বিচার ও ধর্ম্মালাপ করিতে পারিবেন। এই মেলার উৎসবে কোন প্রকার পৌত্তলিক আরাধনা হইবে না ও কুৎসিত আমোদ-উল্লাস হইতে পারিবে না, মদ্য মাংস ব্যতীত এই মেলায় সর্ব্বপ্রকার দ্রব্যাদি খরিদ বিক্রয় হইতে পারিবে।’ শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের মূল উদ্দেশ্য একটা মেলা করা আর দুঃস্থ, সুবিধাবঞ্চিতদের সাহায্য করা। প্রথম দিককার মেলার বর্ণনায় জানা যায়, শান্তিনিকেতন গৃহ থেকে গরিব দুঃখীদের কম্বল, চাল, ডাল, অর্থ বিতরণ করা হত। পরাধীন ভারতে তখন ব্যাপক দারিদ্র। এখনও এই প্রথাটা মেনে চলা হয়। তবে বছরের অন্য সময় তা করা হয়।