কুয়াশাময় পৌষের ভোরে শান্তিনিকেতনের ঘুম ভাঙাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। ছাতিমতলায় সমবেত কন্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে তাঁর ব্রহ্মসংগীত। আশ্রমিকরা ৭ পৌষের উপাসনায় রত । রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘এই সেই ৭ পৌষ, এই শান্তিনিকেতন আশ্রমকে সৃষ্টি করেছে এবং এখনো প্রতিদিন একে সৃষ্টি করে তুলছে।’ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ব্রহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণ এই তারিখেই। ‘শান্তিনিকেতন গৃহ’ উদ্বোধন থেকে পৌষ মেলা সূচনা দিবসের মতো নানা ঘটনাপ্রবাহ অম্লান করে রেখেছে ৭ পৌষ তারিখটি। দীর্ঘ চার বছর নানা টালমাটাল পরিস্থিতি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ফের আয়োজিত হল ঐতিহ্যবাহী পৌষ উৎসব ও মেলা। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতনকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই মাফিক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ শান্তিনিকেতনে এবার প্রথম পৌষ মেলা। আয়োজন কেমন?
প্রায় দুই হাজার স্টল এবারের মেলায়
শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের সম্পাদক অনিল কোনার জানাচ্ছেন, “ট্রাস্ট শেষ মেলা আয়োজন করেছিল ২০১৯ সালে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে করোনার জন্য পৌষ মেলা বন্ধ রাখা হয়। তারপর তিন বছর বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ, রাজ্য সরকারের টানাপোড়েনে মেলা সেভাবে আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। স্বাভাবিকভাবে এই বছর মেলা ঘিরে মানুষের আগ্রহ বাঁধভাঙা। প্রচুর ব্যবসায়ীরা স্টল দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু সবাইকে স্টল দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাও নয় নয় করে এবার মেলার মাঠে প্রায় দুই হাজার স্টল রয়েছে!"
আরও পড়ুন - পুলিশি নিরাপত্তায় শুরু শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা, কী কী ব্যবস্থা থাকছে এবার?
গ্রামীণ কুটির শিল্প থেকে পড়ুয়াদের প্রদর্শনী
দুই হাজার স্টলের মধ্যে প্রায় সবরকম স্টলই রয়েছে পৌষ মেলায়। একদিকে যেমন গ্রামীণ কুটির শিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা শিল্পী, কারিগররা। ডোকরা, কাঠ, পোড়ামাটির দ্রব্য, মনিহারির দোকান, লোহার ঘরোয়া নানা দ্রব্য। মেলার মাঝখানে বিনোদন মঞ্চে বাউলের আখড়া। অন্যদিকে রয়েছে বিশ্বভারতীর স্টল, বিভিন্ন বিভাগীয় পড়ুয়াদের প্রদর্শনী, শীতের পোশাক, গয়না, খাবারের দোকান । এছাড়াও বাচ্চাদের জন্য নাগরদোলা। মেলার মধ্যে প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই বছর। মেলার মাঝে রয়েছে বায়োটয়লেটের ব্যবস্থা। এছাড়া, অপরাধসহ বিভিন্ন অনভিপ্রেত ঘটনা ঠেকাতে পুলিশের হেল্পডেস্ক রয়েছে।
হেরিটেজ হওয়ায় বিশেষ ব্যবস্থা
হেরিটেজ হওয়ার জন্য এবার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানালেন অনিলবাবু। “হেরিটেজ যে অংশটুকুকে ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে এবার কোনও স্টল বসতে দেওয়া হচ্ছে না। আগে পুরনো মেলার মাঠের কাছে ফুটপাতে বিভিন্ন স্টল বসত। এবার সেগুলি আর থাকছে না। তবে উল্টোদিকের ফুটপাতে বসছে আগেকার মতোই।"
আরও পড়ুন - কেন ৭ পৌষেই শুরু হয় শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা ? নেপথ্যে দেবেন্দ্রনাথের এই কাহিনি
‘কেটে গেল বাধো বাধো ভাব’
গত কয়েক বছর মেলা আয়োজিত হলেও তাতে অভাব ছিল স্বতঃস্ফূর্ততার। সে কথাই যেমন ফুটে উঠল এক আশ্রমিকের কথায়। ডোকরার পসার সাজাচ্ছেন এক বিক্রেতা। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে পিনাকী সেন বললেন, “পাঠভবনের প্রাক্তনী হওয়ার সুবাদে ছোট থেকেই মেলা দেখছি। মেলার মূল প্রাণ ছিল মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান। আগে পুরনো মেলার মাঠে পসার সাজিয়ে বসতেন বিক্রেতারা। পূর্বপল্লীর মাঠের থেকে ওই মেলা আয়তনে ছোট হলেও সকলে খোলা মনে যোগ দিতেন। কিন্তু গত ৩-৪ বছর দেখছিলাম, যোগ দিতে হবে বলে যোগ দিচ্ছেন শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীরা। একটা বাধো বাধো ভাব ছিল যা শেষমেশ কেটে গেল এই বছর।"