কলকাতার সন্ধে সাতটা। কিন্তু শুনশান পথঘাট। সবাই জানেন, কখন পৃথিবীর হয়েছিল এই হাল। কোভিডকাল। কলেজ স্ট্রিট থেকে সাইকেলে শ্যামবাজার যেতে যেতে হঠাৎ কানে এল পিছন থেকে একটা ডাক — ‘মিষ্টি খাবে ভাই?’ প্যাডেলে চাপ বাড়িয়ে পাশে চলে এলেন এক বৃদ্ধ। পরনে ময়লা হাফ প্যান্ট, ততোধিক ময়লা স্যান্ডো গেঞ্জি। মুখ জুড়ে ঘাম। কখন যেন সেটা ছলছল চোখের জল হয়ে গিয়েছে । সাইকেলের দু’পাশে দুটো স্টিলের ক্যান বাঁধা। ইঙ্গিত করে বললেন, ‘বড় বড় রসগোল্লা, বেশি দাম নেব না। দুটো খাও। কিস্যু বিক্রি হয়নি সারাদিন।’ এক মুহুর্তের জন্য ভয় দপ্ করে উঠেছিল। কিন্তু এতদিন তো কিছু হয়নি। হতেই পারত। তবু হয়নি। সেই ভরসায় দিলাম দুটো মিষ্টি মুখে পুরে। দশ টাকার নোটটা দশ সেকেন্ড ধরে কপালে ঠেকিয়ে পকেটে পুরলেন বৃদ্ধ।
শুধু দু-চাকার ভরসায়
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিনিবাস ময়রা এখন সাইকেলে মিষ্টি ফেরি করেন। মফস্বলে অবশ্য তাদের বেশি দেখা যায়। ‘কোথায় বাড়ি আপনার?’ বৃদ্ধ বললেন, ‘নৈহাটি’। ‘ওখান থেকে এতদূর সাইকেলে?’ বৃদ্ধের কথায়, ‘আসতে হয় ভাই পেটের টানে। শহরের দিকে বিক্রি বেশি।’ বাড়ি ফিরে মোবাইলে ম্যাপ খুলে দেখলাম নৈহাটি থেকে কলেজ স্ট্রিটের দূরত্ব। ৪০ কিমি। অর্থাৎ রোজ ৮০ কিমি যাতায়াত করেন এই বৃদ্ধ। জীবন খাটিয়ে নিচ্ছে। উনিও খাটছেন শুধু দু-চাকার ভরসায়।
‘কী স্বাধীনতা, কী আনন্দ’
কোভিডকালের দৃশ্য ছিল অনেকটা এমনই। শহর মানে লাখ লাখ মানুষের কর্মস্থান। কোভিডের দু-তিন বছর কলকাতার পথঘাট জুড়ে সাইকেলের রমরমা। বাস, অটোর সংখ্যা কম। রোগের ভয়ে সরকারি, বেসরকারি অফিসযাত্রীদের ভরসাও দ্বিচক্রযান। তবে শুধু কোভিডে নয়, বহু আগে থেকেই সাইকেল বাঙালি জীবনে জড়িয়ে পড়েছিল। জড়িয়ে পড়েছিল একেবারে রুটিরুজির সঙ্গে; যেন ‘দি বাইসাইকেল থিফ’। আন্তোনিওর মতো সাইকেলের সঙ্গে বাঙালির গলাগলি ভাব রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে। কবির ছোটগল্প ‘পণরক্ষা’য় তাঁর চিহ্ন বর্তমান। সাইকেলে উঠেই রসিকের ‘কী চমৎকার, কী স্বাধীনতা, কী আনন্দ’-এর উপলব্ধি। অবন ঠাকুর তো লিখেই ফেললেন, ‘আধুনিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বাইসাইকেল, তাতে তেল লাগে না কয়লা লাগে না। মানুষ বলতে গেলে নিজের পায়েই চলছে কিন্তু গতি কত বেড়ে গেছে।’আরও পড়ুন - HT Bangla Special: ফোর্ট উইলিয়ামের নয়া নাম ‘দেশে’ ফেরাল বর্গিদের? HT বাংলায় আলোচনায় ইতিহাসবিদ
বাঙালির বিপ্লবসঙ্গী
১৮১৭ সালে জার্মানিতে প্রথম আবিষ্কৃত হয় এ ‘গাড়ি’। কিন্তু কলকাতায় এর আবির্ভাব ১৮৮০-র দশকে। ব্রিটিশদের হাত ধরে শুরুয়াৎ হলেও ধীরে ধীরে মফস্বল, গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা, হয়ে ওঠা গরিব ও মধ্যবিত্ত বাঙালির ব্যক্তিগত যান। বিশ শতকের প্রথমভাগে অজস্র বিপ্লবী কার্যকলাপের সাক্ষী থেকেছে এই দু-চাকার যান। রবীন্দ্রনাথের ‘অগ্নিকন্যা’ বিপ্লবী কল্পনা দত্ত তো বেথুন কলেজের ক্যাম্পাসে সাইকেল চালানো শিখতেন, গুপ্ত দলে যোগ দেবেন বলেই।
‘দু চাকায় দুনিয়া
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহন উন্নত হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষের কাছে প্রয়োজনের বদলে শখে পরিনত হয়েছে সাইকেল। তবু দু-চাকার শখ কখনও কখনও মানুষকে দুঃসাহসিক করে তোলে। কেউ বেরিয়ে পড়েন দেশ ভ্রমণে, কেউ বা বিদেশ। যেমন ভূপর্টক বিমল মুখোপাধ্যায়। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। তারপর মায়ের উৎসাহে লিখে ফেললেন ‘দু চাকায় দুনিয়া’। পর্বতারোহী অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায় এই দু-চাকার ভরসায় ভ্রমণ করেছেন আফ্রিকার পাঁচ দেশ। দুঃসাহসিক সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তাঁর ‘দুই চাকায় আফ্রিকা — সাইকেলে ৫ দেশ’ বইয়ে। আবার দশ মাসে দেশের দশ রাজ্য ভ্রমণ করেছেন ত্রিবেণীর শুভাশিস ঘোষ ওরফে পিকলু। ভাঙাচোরা সাইকেলে পাড়ি দিয়েছেন প্রায় দশ হাজার কিলোমিটার।আরও পড়ুন - ‘কালেকশন করতে ব্যস্ত’, ‘চোখ সবসময় ফোনে’! বেলঘরিয়া হাইওয়েতে বারবার দুর্ঘটনায় অভিযোগের তিরে বিদ্ধ পুলিশও
ধরা দিয়েছে মহাকুম্ভও
সাইকেলের রাডারে ধরা দিয়েছে মহাকুম্ভও। নদিয়ার করিমপুরের এক বাসিন্দা কুম্ভস্নানে গিয়েছেন সাইকেলে। আবার স্নান সেরে সাইকেলে করে বাড়ি ফিরেছেন খাতরার রাজ্যপাড়ার বাসিন্দা বাবন খাঁড়া। মহাকুম্ভ, অযোধ্যা ঘুরে আসায় বাড়ি ঢোকার মুখেই তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। মাত্র ২০ বছর বয়সে পুরুলিয়ার অক্ষয় ভগত বেরিয়ে পড়েছিলেন বিশ্ব ভ্রমণে, অবশ্যই সাইকেলে। ৪০১ দিনে গোটা ভারত ভ্রমণ শেষ হয়। ভ্রমণের সময় দেশের আনাচেকানাচে পৌঁছে দিয়েছেন বিদ্যাসাগরের বার্তা — ‘বাল্যবিবাহ রোধ করুন’।
খেলা দেখতে ১৪০০০ কিমি সাইকেলে
বাঙালি শুধু নয়, অবাঙালি ও বিদেশিদের মধ্যেও তীব্রভাবে নিহিত সাইকেল প্রেম। সম্প্রতি পড়াশোনা শেষ করে কলকাতায় এসেছেন ইতালীয় তরুণী এমা। উদ্দেশ্য ভারতবর্ষের সঙ্গে পরিচয়। কিন্তু কীভাবে? এমা জানিয়েছেন, সাইকেলেই তিনি পাড়ি দেবেন কেরালা। পথঘাটের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই চিনতে চান এই উপমহাদেশ। বছর ৩৫-এর জায়া ড্যানিয়েলের গল্পও আরেকটু অবাক করা। সাত বছর ধরে সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ করছেন নিউজিল্যান্ডের এই তরুণী। ২০২৩ সালে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ঘোরার সময় তিনি বলেন, ‘জীবন দর্শনের অভিজ্ঞতা হল আমার’। মঙ্গোলিয়ার ফুটবলপ্রেমী অরিচভ্যান ব্যাটবোল্ড ছোট থেকে স্বপ্ন দেখতেন বড় খেলোয়াড় হবেন। প্রিয় দল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খেলা দেখার চক্করে দালালের খপ্পরে পড়েন। খুইয়ে ফেলেন প্রচুর অর্থ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার ইচ্ছে পূরণ করে সাইকেল। ১১ মাস ধরে ১৪ হাজার কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে তিনি পৌঁছান খেলা দেখতে!আরও পড়ুন - Kolkata Book Fair: মেলা বই, মেলা পাঠক! বইমেলার হিসেব কি শেষমেশ মেলে বই পড়ার সঙ্গে