মূল্যবোধ আর নীতি আদর্শ নিয়েই বেঁচে থাকে ছাপোষা আটপৌরে বাঙালি। রোজকার দৈনন্দিন চেনা ছকে যাঁদের জীবন বাঁধা। সন্তানকে কীভাবে বড় করবেন, কোন স্কুলে পড়াবেন, কেরিয়ার কী হবে, সবকিছু ভেবে নিজের সমস্ত স্বাদ-আহ্লাদ ত্যাগ করে 'সন্তান…সন্তান…সন্তান…সন্তান' করতে করতে জীবন কাটিয়ে দেওয়া। তারপর একদিন সেই ছেলে/মেয়ে বড় হয়ে যায়, অনেক বড় চাকরি করে, স্কাই-হাই ফ্ল্যাটে থাকে আর দামি গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ায়, নতুন সংসার পাতে। তবে সেখানে আর বুড়ো বাবা-মায়ের জায়গা হয় না।
কী সেই নচিকেতার গানটা মনে পড়ে গেল কিনা?
‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/ মস্ত ফ্ল্যাটে যায়না দেখা এপার ওপার/ নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী/ সবচে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি/ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’
গল্প
হ্যাঁ, এই গল্পটা সেই ৯০-এর দশকেই নিজের গানে বলে ফেলেছিলেন নচিকেতা চক্রবর্তী। এই গানটাই একটু বদলে নিলে রাজ চক্রবর্তী-র 'সন্তান'-এর গল্পের প্রেক্ষাপট খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও রাজের ছবিতে বৃদ্ধ বাবা-মা-কে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়নি। তবে বাকিটা অনেকটা এক। সেই একই টানাপড়েন, মানসিক দ্বন্দ্ব, সন্তানকে নিয়ে বাবা-মায়ের আকুলি বিকুলি আর সম্পর্কের তিক্ততা। তারপর সেই দ্বন্দ্ব একদিন পৌঁছে যায় আদালতের দোরগোড়ায়। কিন্তু তারপর? সমস্যার কি সমাধান সম্ভব হল?
এই উত্তরটা অবশ্য আমি দেব না। তাহলে সবটা ফাঁস হয়ে যাবে। তাই এখানেই থামলাম। তবে আপনি নিশ্চয় এতক্ষণে ভাবছেন গল্প যখন চেনা তাহলে আলাদা কী আছে? এমন প্রেক্ষাপটে তো ৯০-এর দশকেও তো বহু ছবি হয়েছে, নতুন কী?
পর্যালোচনা
নতুনত্ব আছে বৈকি। আর এখানেই তো পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর গল্প বলার মুন্সীয়ানা। কারণ, পাকা বাঁধুনিরা জানা আছে বাঙালির চেনা বাড়ির রান্নাও কীভাবে নতুন ভাবে পরিবেশন করতে হয়। রাজও সেটাই করেছেন। আর তাই তো ছবি মুক্তির প্রথমদিনই ভর্তি হলে সিটি পড়ল। অনেকেই ডায়ালগ শুনে আবেগে হাততালি দিয়ে উঠলেন, সবশেষে কাঁদতে কাঁদতে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে হল থেকে বের হলেন বহু দর্শক। তাঁরা তখনও তখনও গল্পে বুঁদ হয়ে আছেন, ছবির গল্পে নিজের জীবনকেও মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কোনও কোনও সন্তান কিংবা বাবা-মায়েরা হয়ত নিজেরাই নিজেদের করে ফেলা ভুলের কথা ভেবে আহত হয়েছেন। মনে মনে ‘Sorry’ বললেন। কারণ, ততক্ষণে মিঠুন চক্রবর্তী তাঁদের শিখিয়ে ফেলেছেন ‘যতবড় ভুল, ততজোরে Sorry বলতে হয়’।
কয়েকজন বয়স্ক মহিলাকে আবার একজোট হয়ে ছবির ডায়ালগ, দৃশ্য নিয়ে নিয়ে কথা বলতে শোনা গেল। মেঘমালা বোস (অনসূয়া মজুমদার)র 'My Husband is not for sale' ডায়ালগটি, আদালতের বাইরে ছেলেকে চড় মারার দৃশ্যটি তাঁদের তখন বেশ মনে ধরেছে। আর এই চড়টা অবশ্য অনসূয়ার হাত ধরে পথভ্রষ্ট হওয়া সন্তানদের গালে মেরেছেন রাজ।
একটু ঘাড় ঘোরাতেই দেখলাম কেউ কেউ আলোচনা করছিলেন আদালত চত্ত্বরে শুভশ্রীর ডায়ালগ নিয়ে। ‘হ্যালো মা, ঠিক আছো? ওষুধ খাচ্ছো, হাঁটুর ব্য়াথাটা ঠিক আছে? বাবাকে একটু ফোনটা দাও তো…’। কেউ কেউ আবার গল্পের প্রসঙ্গ টেনে কার ছেলে বাবা-মাকে দেখে না, খোঁজ নেয় না তা নিয়ে আলোচনা জুড়ছেন। বেশ বোঝা গেল চেনা ছকে বাঁধা ফ্যামিলি ড্রামার মধ্যেই 'পেরেন্টিং' (অভিভাবকত্ব) নিয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি তুলে ধরতে সক্ষম রাজ চক্রবর্তী। শুধু ছেলেমেয়েদের ভুল নয়, সন্তানকে বড় করার সময় বাবা-মায়ের অন্ধ স্নেহও কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, সেটাও হালকা চালে বলে ফেলেছেন।
অভিনয়
রাজের এই গল্প বলায় তাঁর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছেন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। মিঠুন চক্রবর্তীর অভিনয় নিয়ে কথা বলাও ধৃষ্টতা হয়ে যায়। চরিত্রকে কীভাবে জীবন্ত করে তুলতে হয়, তা তাঁর থেকে শিখতে হয়। মায়ের চরিত্রে পারফেক্ট অনসূয়া মজুমদার। আর ঋত্বিক চক্রবর্তী যে কোনও চরিত্রের মধ্যেই দিব্যি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে ঢুকে পড়তে পারেন। উকিলের চরিত্রটি শুভশ্রীও সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। নিজস্ব দক্ষতায় চরিত্রটি আকর্ষণীয় করে তুলেছেন খরাজ মুখোপাধ্যায়। আর নিজের চরিত্রটি সুন্দরভাবে তুলে ধরার জন্য অভিনেত্রী অহনা দত্তরও প্রশংসা অবশ্যই প্রাপ্য।
তাই সবশেষে পুরনো ছক হলেও রাজের কথনভঙ্গীতে মুগ্ধ বহু দর্শককেই তাই পরিবার নিয়ে আরও একবার এই ছবি দেখাতে আসার কথা বলতে শোনা গেল। সবমিলিয়ে রাজের 'সন্তান'কে ৪/৫ দেওয়া যায়।